ক্ষেতের বোরো ধান বেশ কিছুদিন আগেই তোলা হয়ে গেছে,এখন অপেক্ষা বর্ষার পানির জন্য।কিন্তু ভারি বর্ষণের অপেক্ষার সময়টুকু ফসলের জমি যেন এখন ফুটবল মাঠ!যখন ধান কাটা শেষ,তো সবার অবসর হয়ে যায়। তখন আর কাজ থাকে না।এই সময়ে বর্ষার পানির জন্য সবাই অপেক্ষায় থাকে।মধ্যে তিন বা চার সপ্তাহ ফসলের মাঠে ফুটবল নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় গ্রামের শিশু-কিশোররা।"এই সময়ে গ্রামীণ ছেলেরা কখনও এপাড়া বনাম ওপাড়া,আবার কখনও গ্রাম বনাম গ্রামে ভাগ হয়ে ফুটবল নিয়ে মেতে উঠেছে সেই মাঠে।
খেলার এই দল কখনও ভাগ হয় বিবাহিত-অবিবাহিতেও,ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা নামে হয় ভাগ।
১১ জুন শুক্রবার এমন একটি গ্রামীণ ফুটবল খেলার চিত্র দেখা গেল ময়মনসিংহের ফুলপুরে উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের উত্তরকান্দা গ্রামে।বিকাল বেলায় গ্রামটির এপাড়া ওপাড়া দুই দলে ভাগ হয়ে মাঠে নামে ফুটবল খেলতে।মাঠের সীমানার বাইরে থেকে তাদের উৎসাহ দিতে ছিল গ্রামবাসী।
সভ্যতার ক্রমবিকাশ আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ খেলাধুলা।ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাধুলা নির্মল আনন্দের জীবন্ত উৎস, বিনোদনের খোরাক।আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই আজ বিলুপ্তির পথে।
গ্রামীণ জনপদে এখনও কিছু খেলাধুলা চোখে পড়লেও উৎসাহ-উদ্দীপনা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তাও প্রায় বন্ধ হতে চলেছে।
একসময় গ্রামীণ সমাজের শিশু কিশোররা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন খেলাধুলার মাধ্যমে অবসর সময় কাটাত।বিকাল হলেই খোলা মাঠে দল বেঁধে খেলতে যেত।শিশু মানেই দৌড়ঝাঁপ,কোলাহল আর দুরন্তপনা। দুরন্তপনা ছাড়া যেন শৈশব কল্পনাই করা যায় না।অথচ প্রযুক্তির এ যুগে শিশুদের মধ্যে, বিশেষ করে শহরের শিশুদের মধ্যে দুরন্তপনা যেন আর নেই বললেই চলে।ঘরে বসে কম্পিউটার,মোবাইলে গেমস খেলতেই তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
একসময় রাখাল ছেলেরা মাঠে গরু চরাতে গিয়ে ডাংগুলি খেলত।স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা স্কুলের টিফিন সময়ে নানা ধরনের গ্রামীণ খেলা নিয়ে মেতে থাকত। বর্তমানে শহরাঞ্চলে তো বটেই,গ্রামাঞ্চলেও খোলা জায়গা বা খেলার মাঠের স্বল্পতার কারণে এসব খেলা আর তেমন চোখে পড়ে না।
৫-৭ বছর আগেও প্রতিটি গ্রামের স্কুল মাঠ এমনকি ধান কাটার পর খালি মাঠে এবং বাড়ীর পাশের খালি জায়গায় পর্যন্ত চলতো বিশেষ করে ফুটবল এবং হাডুডু খেলার তীব্র প্রতিযোগিতা।এ সব খেলায় স্বর্ণ-রোপ্য দিয়ে তৈরি কাপ এমনকি গরু পর্যন্ত উপহার দেয়া হতো। কতোই না মজা হতো যখন এক গ্রামের সাথে অন্য গ্রাম,এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমন কি বিবাহিত বনাম অবিবাহিতদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো।
গ্রামাঞ্চলের হাজার হাজার উৎসুক জনতা এ সব প্রতিযোগীতা দেখে কতই না আনন্দ উপভোগ করতেন।শুধু যে গ্রামে তা কিন্তুু নয়, শহরের ছোট ছোট ছেলেরাও ফুটবল এবং হাডুডু খেলার প্রতিযোগিতায় অঙ্কগ্রহন করতো।এ সব খেলায় দূর-দূরান্ত থেকে ভাল ভাল খেলোয়ারকে আনা হতো পক্ষে খেলে দেয়ার জন্য যাকে স্থানীয় ভাষায় 'হায়ার' বলা হয়।
যাদেরকে খেলার জন্য হায়ারে আনা হতো তাদের খাওয়ানো হতো জামাই আদরে এবং দেয়া হতো মোটা অংকের টাকা উপঢৌকন। অনুরূপ খেলা ঐতিহ্যবাহী হা-ডু-ডু।বর্তমান এই যুগে যার স্থান দখল করে নিয়েছে বলতে গেলে ক্রিকেট খেলা।এ সব ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাগুলো বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কাছে মনে হবে রূপকথার গল্পের মতো।সে সময়তো স্কুল-কলেজ ছুটির পর শিক্ষার্থীরা বাড়ীতে এসে নিয়মিত বিকালে বাড়ীর পার্শ্বে মাঠে,বাড়ীর উঠানে এ সব খেলা খেলতো।আজ আর সেই দিন নেই !নেই আগের সে সব গ্রামীণ খেলাধূলা।তবে এখন ও কিছু কিছু ফুটবল,হাডুডু এবং ক্রিকেট খেলা চোখে পড়ে।তাও কালেভদ্রে।
আগেরকার দিনে গ্রামাঞ্চলে বিশেষ দিবসে হা-ডু-ডু, কাবাডি ও লাঠিখেলার জন্য প্রতিযোগিতা হতো।বিভিন্ন গ্রামে এসব খেলার জমজমাট আয়োজন হতো।এসব খেলা দেখার জন্য অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ দলে দলে এসে উপস্থিত হতো খেলার মাঠে।খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণ করা হতো। ভালো খেলোয়াড়দের সমাজের সবাই অনেক সম্মান করত।
খেলার মাঠের স্বল্পতা,স্মার্টফোনে ভিডিও গেমসের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির কারণেই গ্রামীণ খেলাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লাল-সবুজ ফ্রেন্ডস ক্লাবের সভাপতি অমিত দেওয়ান।
বোরো ক্ষেত থেকে বছরে এককালীন ফসল উঠানোর পর এইভাবে ফুটবল খেলা গ্রামীণ ঐতিহ্যের অংশ বলে মন্তব্য করেন ওই গ্রামের বাসিন্দা আলহাজ্ব রফিক উল্লাহ মাস্টার।এই প্রৌঢ়ের ভাষ্য,"আমরাও যখন ছোট ছিলাম, ধরেন আরও ৪০/৪২ বছর আগে, তখন আব্বার কাছে বাইনা ধরতাম একটা ফুটবল কিনে দেওয়ার জন্য।সেই ফুটবল নিয়ে এভাবেই মাঠে খেলতাম।"
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোতালেব দেওয়ান জানান।যুব সমাজ ও কিশোর-কিশোরীরাও এখন খেলাধুলার পরিবর্তে স্মার্ট মোবাইল ফোন ট্যাব,ল্যাপটপ,কম্পিউটার বা টিভির স্ক্রিনে বন্দি হয়ে পড়ছে।ঘরের চার দেয়াল আটকে যচ্ছে দুরন্ত শৈশবের প্রাণচঞ্চল জীবন। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তি যেমন ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাকে কেড়ে নিয়েছে,তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে।গ্রামীণ খেলাকে বাঁচাতে সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: গোলাম মোস্তফা, গণমাধ্যমকর্মী