সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার প্রত্যন্ত অজপাড়াগায়ের নাটানা গ্রামে জন্ম আমার। গ্রামের অপরূপ সৌন্দর্য্য সবারই মনে টানে আর যখন গ্রাম ছেড়ে, স্বদেশ ছেড়ে, প্রবাসে পাড়ি দেওয়া তখন মনে হয় গ্রামের প্রতি, গ্রামের মানুষের গায়ে মাটির গন্ধের প্রতি মোহতা আরও বেড়ে যায়। ছোট থেকেই দেখে এসেছি গ্রামের সবুজে শ্যামলে ঘেরা, সুজলা সুফলা মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি। সেই সময়ে ধানের ক্ষেতের ভিতর দিয় এঁকেবেঁকে চলা মেঠো পথ, বন্ধুদের সাথে দলবদ্ধ ভাবে নদীতে ঝাঁপ দেওয়া থেকে শুরু বাবা মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুপুরের রোদে মাঠে গিয়ে ঘুড়ি উড়ানো, বাড়ির কাজের লোকের সাথে মহিষ চরানোর স্মৃতি এখনো সুস্পষ্ট ভাবে মনের মনিকোঠায় ভেসে ওঠে।
![]() |
ছবিঃ শিল্পির তুলিতে আঁকা গ্রামের চিত্র (উৎসঃ ফেসবুক পেজ) |
![]() |
ছবিঃ ধানের গাদা সহ গ্রাম্য পরিবেশের চিরাচরিত ছবি (উৎসঃ গুগল) |
![]() |
ছবিঃ মহিষের সাহায্যে ধান মাড়ায়ের চিত্র (উৎসঃ গুগল) |
![]() |
ছবিঃ গ্রামের বধুদের বাতাসে চিটা ধান উড়িয়ে ধানের ভুসি ঝাড়ার ছবি (উৎসঃ উইকিপিডিয়া) |
ছোট থাকতে দেখেছি অনেক ধান উঠত আমাদের বাড়িতে। ঠেলা গাড়িতে করে ধান কেটে বাড়ি তুলত, তারপরে সেগুলোর গাদা (এক জায়গায় জমিয়ে উঁচু করে রাখা) দিয়ে রাখত কয়েকদিন। সময় সুযোগ এবং আবহাওয়া বুঝে সেগুলো নিজেদের মহিষ দিয়ে মলন (মাড়াই) দিত। অনেক ধুমধাম চলত এই সময়, ধান মাড়াই করে গোলায় (ধান রাখার ঘর) তুলতে পারাটা ছিল যেন বাড়ির সবারই সবচেয়ে বড় একটা স্বস্তির কাজ। মা-কাকিমা, ঠাকুরমা-ঠাকুরদাদা, বাবা-কাকা কারো যেন দম ফেলার সময় থাকত না। চারিদিকে পাকা ধানের গন্ধে মুখরিত থাকত। ধান মাড়াইয়ের পরে সেগুলো থেকে ভুসি (ধানের চিটা/অপরিপক্ক ধান) ঝেড়ে ওইদিনের ভিতরে গোলায় তোলা হত। সবকিছু নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর শেষ করতে হবে সেই অনুযায়ী কাজের লোক নেওয়া হত। যেদিন ধান মলনের কাজ চলত সেদিন সকাল থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত সবাই ব্যস্ত থাকত। কোন কোন সময় ধান মাড়াইয়ের রাতে বাবাকে হ্যাঁচাকের (আগেকার দিনে ব্যবহৃত কেরোসিনের সাহায্যে জ্বালানো বিশেষ আলো) ব্যবস্থা করতেও দেখেছি। আমরা ছোট থাকলেও মনের ভিতর ওইদিন একটা উৎসব মুখর পরিবেশ কাজ করত। তাই ওইদিন পড়ালেখা, স্কুল যাওয়া থেকে অঘোষিত ছুটি ভোগ করতাম।
![]() |
ছবিঃ শীতের সময় তৈরি গ্রাম্য বিভিন্ন সুস্বাদু পিঠা (উৎসঃ গুগল) |
![]() |
ছবিঃ সারারাত রসে ভিজানো চিতই পিঠা (উৎসঃ ফেসবুক পেজ) |
![]() |
ছবিঃ শীতের সকালের আগুন পোহানোর চিত্র (উৎসঃ গুগল) |
![]() |
ছবিঃ গ্রামের বঁধুদের ঢেঁকিতে ধান ভানার দৃশ্য (উৎসঃ গুগল) |
ধানের ভুসি ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার পরে সেগুলো ঠাকুরমা জমিয়ে রাখত এবং সুবিধামত সময়ে রাস্তার পাশে যেখানে বেশি বাতাস বয়ে যাচ্ছে সেখানে পাটি (ধান বিছানোর মাদুর) বিছিয়ে ওই ভুসি থেকে দ্বিতীয় বারের মত আরও কিছু ধান সংগ্রহ করত। নিজেদের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি ধান হত আমাদের তাই ধানের গলা ভরার পরে উদ্বৃত্ত ধান বিক্রি করে দেওয়া হত। নৌকায় করে অনেক পাটের বস্তা সহ ধান কিনতে ব্যাপারী আসত। বেতের ঝুড়ির তৈরি পাঁচ সেরের পাল্লা ছিল। ধান বিক্রির সময় বাবা ধান মাপত, ধান মাপার সময় বাবার বাম হাতে পাল্লার মোটা দড়িটা ধরে ডান হাতে পাল্লায় ধান কাটাতে কাটাতে ১/২/৩ গোনার সুরটা এখনো মনে পড়ে। নতুন ধান ওঠার পরপরই শুরু হয়ে যেত পিঠা পুলি তৈরির ধুম। আমাদের এলাকায় বেশি প্রচলিত ছিল চিতই পিঠা, তেলের পিঠা, পুলি পিঠা, রসের পিঠা এবং পাটিসাপটা পিঠা। এগুলোর ভিতর আমার খুবই প্রিয় ছিল চিতই পিঠা। সাথে থাকত চালের গুড়ো, দুধ এবং খেজুরের গুড় দিয়ে বানানো খির। সারারাত খেজুরের রসে ভেজার পরে সকালে উঠে টসটসে পিঠা গুলো থালায় করে খেতে দিতেন মা। অনেক তৃপ্তি নিয়ে আমরা ভাইবোনেরা একসাথে শীতের সকালে রোদে গিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে বসতাম পিঠা খেতে।
বাড়িতে ঢেঁকি ছিল, তালে তালে পা ফেলিয়ে ঢেঁকিতে ধান ভানা চলত, চলত পিঠা বানানো চাল গুড়ো করার কাজও। শীতের সকালে ফ্যানে ভাত (জাও ভাত) রান্না করত মা। আগে থেকে তৈরি করে জমিয়ে রাখা তালের গুড় দিয়ে বাড়ির সবাই মিলে সেই ভাত খেতাম। সন্ধ্যায় পাড়ায় আলাদা করে বসানো হতো চিড়ে বানানোর ঢেঁকি। ঢেঁকির পাশেই রাখা চুলোয় ধান অল্প সিদ্ধ করে ঢেঁকির নির্দিষ্ট স্থানে দিয়ে ঢেঁকিতে চার পাঁচ বার পাড়া দিতেই তৈরি হয়ে যেত চিড়া। আমরা গোল হয়ে অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম কখন সেটা খাওয়ার উপযোগী হবে তার জন্য। চিড়া তৈরি হওয়ার পরে সেগুলোকে কুলোয় ঝেড়ে গরম গরম খাওয়ার যে মজা সেটা এখনো ভুলতে পারি নাই। শীতের ভোরে গায়ে চাদর জড়িয়ে সব বন্ধু বান্ধবরা একসাথে বের হতাম আগুন পোহাতে। সবাই মিলে আগের দিন জমিয়ে রাখা খড়, লতাপাতা, কাগজের টুকরো দিয়ে সাজাল (আগুন পোহানোর জন্য সবাই গোল হয়ে আগুনের চারপাশে বসা) পোহানোর কাজ চলত সূর্যের আলো দেখার আগ পর্যন্ত।
ছোট থাকতে দেখেছি তখনও আমাদের ১৫ টা মত মহিষ ছিল। এসবের বেশীরভাগই ধান বপনের জন্য জমি চাষ এবং দুধ উৎপাদনের জন্য পালা হত। সারাবছরই তিন থেকে চারটা মহিষ দুধ দেওয়ার উপযোগী থাকত সেজন্য প্রচুর দুধ হতে দেখেছি। সকালে গোয়ালা আসত দুধ কিনতে, আর বাড়িতে খাওয়ার জন্য রেখে দেওয়া হত ছোট্ট একটা কলসের (প্রায় ৪ লিটার) এক কলস মত দুধ। কোন কোন দিন গোয়ালা আসত না সেদিন বাড়িতে ঘি, মাখন বানানোর জন্য দুধের ঘোল টানা হত। একটা হাঁড়ির ভিতর দুধ রেখে সেটাতে বাঁশের একটা লাঠির মাথায় বিশেষ ব্যবস্থা করে কপি কল তৈরি করে দড়ি দিয়ে দুধের ভিতর কিছুক্ষণ ঘোরাতেই দুধ থেকে মাখন ভেসে উঠত। পরে সেই মাখন আগুনে জালিয়ে ঘি বানানো হত। ঘি বানানোর পরে যে ছিটেটা (মাখনের ভাজা অবশিষ্ট অংশ) থাকত ওটা আমার খুব প্রিয় ছিল, তাই কেউ জানার আগেই লুকিয়ে ওটাকে কুড়মুড় করে সবার আগেই খেয়ে নিতাম। মাখন ওঠানোর পরে হালকা লবন মিশিয়ে ঘোলের স্বাদ ও মুখে লেগে থাকার মত ছিল।
![]() |
ছবিঃ তাল গাছ থেকে রস বের করার চিত্র (উৎসঃ গুগল) |
গরমের দিনে আমাদের অনেক তালের রস হতে দেখেছি। দিনে প্রায় ৭-৮ কেজি মত গুড় হত। মেজো কাকা ছিল রস থেকে গুড় তৈরিতে সবথেকে বেশি পারদর্শী ছিল। আমরা বাচ্চারা সবাই বসে থাকতাম রস জ্বালিয়ে কখন গুড় হবে সে প্রতীক্ষায় কারণ গুড় ঢালার পরে পাত্রের অবশিষ্ট গুড় চেটেপুটে খাওয়ার জন্য তখন জড় হয়ে যেত সমবয়সী পাড়ার অনেকেই। ঠাকুরমা বিকেলে ব্যস্ত হয়ে পড়ত লবন বানানোর কাজে। মাঠের উপরে জমা হওয়া লবন যুক্ত মাটির আস্তরণ ঠাকুরমা আগে থেকে জড় করে রাখত। এরপর আমি সেগুলো বস্তা ভরে সাইকেলে করে বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছে দিতাম। এরপর সেগুলো থেকে ছাঁকন প্রক্রিয়ায় বিশেষ কায়দায় লবন জল বের করে নিয়ে বাড়িতেই লবন বানাতো আমাদের। এইসব প্রক্রিয়াগুলো ছিল যেন অশিক্ষিত মানুষের বিজ্ঞানের যথাযথ ব্যবহারের বাস্তব উদাহরণ। উঠানে বড় বড় চুলা তৈরি হত, তালের রস আর লবনের জল জালানোর জন্য। আমরা ক্ষেত থেকে নতুন লাগানো গাছের গোড়া থেকে মাটি খুঁড়ে ছোট ছোট নতুন আলু বের করে সেই লবন জলের ভিতর দিতাম, পরে সিদ্ধ হলে সেই লবনের স্বাদ যুক্ত আলু খুবই তৃপ্তি সহকারে খেতাম। খড় দিয়ে জ্বালানো হত ওই বড় বড় চুলাগুলো।
![]() |
ছবিঃ বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুপুরের রোদে ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্য (উৎসঃ গুগল) |
![]() |
ছবিঃ শৈশবে মার্বেল খেলার চিত্র (উৎসঃ গুগল) |
![]() |
ছবিঃ পরিত্যাক্ত কলাগাছ দিয়ে বানানো ভেলায় পুকুরে ভেসে বেড়ানো (উৎসঃ গুগল) |
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়তাম মাঠে ঘুড়ি উড়াতে। মেজ কাকা অনেক বড় বড় ঘুড়ি বানিয়ে দিত আমাকে। বড় ঘুড়ির টানে শক্ত নাইলনের সূতা নাটাই সহ নিজ হাতে ধরে রাখাটা মাঝে মাঝে দুস্কর হয়ে পড়ত। প্রায়ই ছেলেমেয়ে সবাই একসাথে খেলতে বের হতাম। লুকোচুরি, বউচি, কানামাছি, বেগুন ঢিবঢিবি, ডাংগুলি সহ আরও হরেক রকমের আঞ্চলিক খেলা প্রচলিত ছিল আমাদের ওখানে। এছাড়া মার্বেল খেলায় ও বেশ মেতে উঠতাম আমরা সবাই। মাঝেমধ্যেই সব বন্ধুরা মিলে চড়ুই ভাতি খেলার ফন্দি আটতাম, সবার বাড়ী থেকে নির্দিষ্ট পরিমান চাল, ডিম, তরকারী সহ হাজির হতাম সাথে মাথাপিছু ৩/৪ টাকা করে উঠাতাম রান্নার বাকি মসলা পাতি কেনার জন্য। সবাই সামনে কলাপাতা বিছিয়ে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম কখন রান্না শেষ হয়ে সেই লোভনীয় অর্ধ সিদ্ধ খাবার পাতে আসবে তার জন্য।
![]() |
ছবিঃ শৈশবে দুরন্তপনার চড়ুই ভাতি খেলার চিত্র (উৎসঃ গুগল) |
বর্ষার সময় সকালে বাড়ীর সবাই পান্তা খেতাম। সারা রাত জলে ভিজিয়ে রাখা ভাত সকালে পান্তা হয়ে যেত সেটা ঘোল বা দুধ দিয়ে খাওয়ার স্বাদটা ছিল অসাধারণ। বাড়ীর সবাই তালের গুড় দিয়ে পান্তা খেলেও আমার খুব প্রিয় ছিল নারকেল কোরানো দিয়ে পান্তা খাওয়া। এজন্য বাড়ীর গাছ থেকে নারকেল পেড়ে আগে থেকে জমিয়ে রাখতাম সেগুলো পান্তা ভাতের সাথে খাব বলে। আমাদের অনেক বড় কলা গাছের বাগান ছিল এবং ঠাকুরদাদা এই বাগানের দেখাশুনো করত। অপেক্ষায় থাকতাম কখন ঠাকুরদাদা গাছ থেকে কলা কেটে নেওয়ার পরে গাছ গুলো ফেলে দেবে। ফেলে দিলে সেই কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে পুকুরে নৌকার মত ভেসে ভেসে সারা দুপুর মাতিয়ে বেড়াতাম। বিকালে ঠাকুরমার সাথে বের হতাম ছিপ নিয়ে খালে বিলে কই, শোল, পুটি সহ টেংরা মাছ ধরতে। এছাড়াও দীঘি, বড় জলাশয়, খাল বিল থেকে গলা জলে নেমে নিজেদের বহনযোগ্য শাপলা, ঢ্যাপ, শালুক তুলে আনতাম। শাপলা ফুলের গাছের লম্বা ডাটা দিয়ে মালা করে সেগুলো গলায় পরে সবাই ঘুরে বেড়াতাম।
![]() |
ছবিঃ দল বেঁধে বুক জলে নেমে শাপলা, ঢ্যাপ, শালুক তুলে আনা (উৎসঃ গুগল) |
প্রায়ই বাড়ির কাজের ছেলের সাথে যুক্তি করে কাউকে না জানিয়ে মহিষ চরাতে বের হতাম। বাড়ীর কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে জোয়ার হলে সে মহিষ গুলোকে চরাতে নিয়ে যেত। আমি মহিষের পিঠে বসে মহিষের কান দুটো শক্ত করে ধরে রাখতাম। মহিষ ছুটে চলত ভরা নদীতে স্রোতের অভিমুখে। কিছুক্ষণ পরে পরে জলে মুখ ডুবিয়ে ডুবিয়ে মাটির গায়ে বেড়ে ওঠা ছোট ছোট ঘাস খেত। নদী দিয়ে স্পীড বোট বা লঞ্চ গেলেই নদীর পাড়ে অন্যান্য বন্ধুদের সাথে দলবেঁধে ছুটে যেতাম পায়ে ঢেউ লাগাতে। তখন নদীতে বাতাসের গতিকে কাজে লাগিয়ে নৌকায় বেগ দেওয়ার জন্য পালতোলা ছোট বড় বিভিন্ন আকারের নৌকা দেখা যেত। মাঝেমধ্যে দেখতাম যখন স্রোত এবং বাতাস কোনটায় অনুকুলে থাকত না তখন নৌকায় গুন টেনে মাঝিরা তাদের গন্তব্যে পাড়ি দিত। নাব্যতা সংকটের কারণে তখন নদীতে মাঝেমধ্যেই সারি সারি অনেক বড় বড় লঞ্চ, কারগো, ফেরি আটকে যেত। খুবই মজা পেতাম যখন দেখতাম লঞ্চ আটকে আছে দিনের পর দিন, তখন আমরা সবাই লঞ্চে গিয়ে উঠতাম। হঠাৎ একদিন দেখতাম নতুন জোয়ারের জল পেয়ে রাতের অন্ধকারে সব লঞ্চ গুলো উধাহ হয়ে গেছে।
তখন কার দিনে ইন্টারনেট তো দূরের কথা মোবাইল ফোন কি জিনিস সেটা ছিল না। সারা গ্রাম ঘুরেও হয়ত একটা টেলিভিশন খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল। নব্বইয়ের দশকে আমাদের বাড়ী সাদাকালো একটা টেলিভিশন আসলে সেটা দেখার জন্য গ্রামের সবার লাইন পড়ে যেত। বিশেষ করে শুক্রবার রাতে তখনকার জনপ্রিয় মেগা সিরিয়াল আলিফ লায়লা দেখার জন্য উপচে পড়া ভিড় হত। ভিড়কে সামাল দিতে ওইদিন টেলিভিশন উঠানে বের করে দিতাম। আরব্য উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত আলাদীন, আলিবাবা, মর্জিনা, সিন্দাবাদ, কেয়ারম্যান সহ আরও অনেক দুঃসাহসিক চরিত্রের কথা এখনো মনে ভেসে উঠে। লম্বা বাঁশের মাথায় এন্টেনা লাগিয়ে বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিটিভি (বাংলাদেশের সরকারী টেলিভিশন চ্যানেল) এর চ্যানেলের নিখুঁত ছবি দেখার জন্য সবাই অনেক উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় থাকত। শুক্রবার দুপুর থেকে বিটিভিতে প্রচারিত বাংলা ছায়াছবি দেখার জন্যও যথেষ্ট মানুষের উপস্থিতি লক্ষনীয় ছিল। বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় ১২ ভোল্টের বড় ব্যাটারী দিয়ে টেলিভিশন চালানো হত। সেজন্য ছায়াছবি চলাকালীন যখনই বিজ্ঞাপন বা সংবাদের সময় হত তখন ব্যাটারীর চার্জকে যথাসম্ভব বাঁচানোর জন্য টেলিভিশন বন্ধ করে রাখতাম।
![]() |
ছবিঃ মহিষের পিঠে চড়ে মহিষ চরানোর স্মৃতি (উৎসঃ গুগল) |
![]() |
ছবিঃ গ্রাম্য হাট বাজারের দৃশ্য (উৎসঃ উইকিপিডিয়া) |
সপ্তাহে শনি আর মঙ্গল বার এই দুইদিন বাড়ি থেকে মাইল খানিক দূরে হাট বসত। ঠাকুরদাদার কাঁধে বসে হাটে যেতাম, বেশি মজা হত যখন দেখতাম ঠাকুরদাদা বৃষ্টিতে কাদায় আঙুল টিপে টিপে আমাকে কাঁধে নিয়ে হাটে চলে গেছে। আমি কাঠের বাট ওয়ালা পুরু কালো কাপড়ের ছাতাটা শক্ত হাতে ধরে ঠাকুরাদাদার কাঁধে বসে থাকতাম। হাটে গিয়ে অনেক কষ্টে ঠাকুরদাদার থেকে ২/১ টাকা ম্যানেজ করতে পারতাম পরে সেটা দিয়ে গুড়ের গজা (আখের গুড় এবং ময়দা দিয়ে বানানো বিশেষ মিষ্টি জাতীয় খাদ্যদ্রব্য), চিট কটমা (চিনি দিয়ে বানানো অনেক শক্ত একটা খাবার), পিয়াজু, সিঙ্গারা কিনে খেতাম। তখনকার দিনে পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে বাঁশের চিকন কাঠিতে ধরার বিশেষ ব্যবস্থায় মালাই (আইসক্রিম) পাওয়া যেত, গরমের দিনে ওটা আমাদের মত বাচ্চাদের খুবই লোভনীয় একটা খাবার ছিল।
খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে সবকিছুই আজ বিলীন। গ্রামের সেই হাট এখন আর বসেনা, হাটকে সবাই এখন বাজার বলে, সপ্তাহের প্রতিদিনই বাজার বসে। চাইলেও এখন আর কেউ বাড়িতে ঘি মাখন বানাতে পারেনা। পাশের নদীতে এখন আর জল নেই, জোয়ারের পানিতে ও পায়ের পাতা ডোবেনা। সেই লবন জল জ্বালানো, গুড়ের পাটারী বানানো সত্যিই এখন খুবই বেমানান। এখন পহেলা বৈশাখে গরম ভাতে জল ঢেলে দিয়ে সেটাকে পান্তা বলা হয়। লুকোচুরি, কানামাছি বাদ দিয়ে বাচ্চারা এখন স্মার্ট ফোনে সারাক্ষন টম জেরি, ডোরেমন দেখায় ব্যস্ত। চড়ুই ভাতি ভুলে গিয়ে বাচ্চাদের আমরা এখন নামীদামী রেস্তোরায় ফ্রাইড রাইস, পিজ্জা, বার্গার খাওয়াতেই অভ্যস্ত। মানুষ এখন অনেক আধুনিক, আমরাও এর ব্যতিক্রম নয়। সময়ের সাথে সাথে হয়ত আরও আধুনিক হব। কিন্তু ছেলেবেলার এই স্মৃতিগুলো সত্যিই খুব কাঁদায়। ঠাকুরদাদা আজ বেঁচে নেই, ঠাকুরমা ও বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে, মেজ কাকা সপরিবারে ভারতে। আমরাও মা-বাবা, ভাই-বোন সহ অন্যান্য স্বজন ছেড়ে দূর প্রবাসে। দূরে আছি, বহু দূরে তবুও মাটির টানে ফিরে ফিরে দেখি আমার রূপসী বাংলা, আমার কাদামাটিতে মাখা সোনালী শৈশবকে। স্মৃতির পাতায় অক্ষরগুলি অস্পষ্ট হয়ে গেলেও একেবারে মুছে যায়নি আর তাইতো সেই ছেলেবেলার মত করে সবার কাছে ফিরে যেতে খুবই ইচ্ছে হয়। মনে বার বার উঁকি দেয় সেই সোনামাখা শৈশব। সব শেষে নিজের স্ব-রচিত ছন্দে মিলিয়ে শেষ করতে চাই-
কোথায় হারিয়ে গেল সবুজে ঘেরা গ্রাম্য সে বসবাস
কোথায় গেলে পাব আজ সেই বুক ভরা বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস‖
ইট পাথরের কৃত্রিম শহরে প্রাণ খুঁজে না পাই
সবই আছে প্রয়োজনের অধিক তবুও মন ভরানো দায়‖
মনে পড়ে সেই মায়ের সাথে, ছনের ছাউনির টাবুরী নৌকায় বসে
মামার বাড়ী গিয়েছিনু খেতে, কত পিঠা পুলি আর পায়েসে‖
দেখেছি নদীর বুকচিরে চলা, পাল তোলা নৌকার মাঝিমল্লার ভিড়
দখলদারদের ক্ষমতার জোরে আজি সেসব নদী পথ বিলীন‖
হারিয়েছে বন বাদাড়ে ঘেরা সর্পিল মেঠো পথ
কোথাও নেই যেন প্রানের স্পন্দন, আছে শুধু হাহাকারের আর্তনাদ‖
প্রকৃতি আজ বিরূপ বেজায় মানুষেরই কৃত কাজে
আপন দোষে মানব সভ্যতার আজ হুমকির ঘন্টা বাজে‖
শৈশবের সোনা ঝরা দিনে, মন খুব করে ফিরে যেতে চায়
অসম্ভব জেনেও সে স্মৃতি আজ মনের মনিকোঠায় অমলিন জেগে রয়‖
ভালো থাকবেন সবাই। সকলের শুভ কামনায়।
লেখকঃ অজয় কান্তি মন্ডল
গবেষক
ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি
ফুজিয়ান, চীন।