চীন নামটা শুনলেই আমরা বাংলাদেশী সহ আশপাশের অনেক দেশের মানুষ নাক শিটকাই। সেটায় স্বাভাবিক, দেশে কমদামী চীনা পন্যের রমরমা বাণিজ্য দেখে আমরা ভাবি চীন ও এই কমদামী জিনিসের মত নড়বড়ে। কিন্তু বাস্তবতা আসলে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। ছোট্ট একটা গল্প দিয়ে শুরু করতে চাইঃ গতবছর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন উপলক্ষে দেশ থেকে কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে এসেছিলেন। ওনাদের বেশিরভাগই ছিলেন প্রথমবার চীনে এসেছেন এমন। ওনাদের ইচ্ছা ছিল এখান থেকে সস্তায় কিছু চীনা পণ্য কিনে দেশে নিয়ে যাবেন। তাই বলতে গেলে একবারে খালি লাগেজ নিয়ে ওনাদের এখানে আসা এবং কমদামী চীনা পণ্যে লাগেজ ভরে দেশে নেওয়ার ইচ্ছা। স্যাররা ইতোমধ্যে বেশ কিছু উন্নত দেশ ভ্রমন করছেন কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতা নাকি তাঁদের ধারনার বাইরে। রাস্তা, ট্রাফিক ব্যবস্থা আর সু-উচ্চ নজর কাড়া বিল্ডিং গুলো স্যারদের খুব বেশি আকর্ষণ করেছিল। স্যারদের নিয়ে সন্ধ্যায় আমরা কয়েকজন দেশি বন্ধু মিলে বের হয়েছিলাম ওনাদের আবাসিক হোটেলের আশপাশের কিছু মার্কেটে একটু ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে। কিছু শপিং মল, লোকাল মার্কেট ঘোরার পরে স্যাররা কিছুই মেলাতে পারলেন না অন্তত যেগুলো দিয়ে লাগেজের অল্প একটু জায়গাও ভরা যায়। একজন স্যার আমার কানে এসে ফিস ফিস করে বললেন ‘কমদামী কিছু কম্বল, সিট কাপড় আমার খুব দরকার ছিল’ এখানে পাওয়া যাবে কিনা। আমি স্যার কে বললাম ‘এখানে যেগুলোর যেমন দাম দেখলেন সবখানে ওই একই রকম হবে, দামের খুব সামান্য হেরফের হতে পারে’। স্যারেরা বললেন ‘এর থেকে আমাদের দেশেই ভাল, অনেক কম দামে ভালো ভালো চাইনিজ জিনিস পাই’।
কোন হেল্পার বা অন্য কারো সাহায্য ছাড়া বিশাল বড় বড় বিলাস বহুল পাবলিক বাস একজন মহিলা বা পুরুষ চালকের তত্ত্বাবধায়নে যথাসময়ে গন্তব্যে আসা যাওয়া করছে। প্রতিবার রাউন্ড দেওয়ার পরপরই গ্যারেজে ঢুকলে দায়িত্বরত ব্যক্তি ১-২ মিনিটের ভিতর বাস গুলোকে ধুয়ে মুছে একবারে পরিস্কার করে দিচ্ছে। সবগুলো বাসে জিপিএস ব্যবস্থা চালু করা তাই চালক ইচ্ছে করলেই একজায়গায় দাঁড়িয়ে সময় ক্ষেপণ করবে সে সুযোগ নেই। বাসগুলো সবই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত, ভিতরে টিভি পর্দায় সার্বক্ষণিক বিভিন্ন ভিডিও চলে এবং প্রতিটা স্টপেজ আসার আগেই টিভি পর্দায় যাত্রীদের দের সতর্কতা মূলক ঘোষণা দেওয়া হয়। ১ ইউয়ান (~১২.৫ টাকা) দিয়ে ৫০-৬০ কি.মি. মত যাওয়া যায়। তবে যেখানেই নামবেন ওটাই দিতে হবে সেটা এক স্টপেজ পরে হলেও (অন্য প্রদেশে কম বেশি হতে পারে)। বাসের দরজা গুলো খোলা এবং বন্ধ হওয়া চালক তার সিটে বসেই নিয়ন্ত্রণ করে। সামনের দরজায় যাত্রী ওঠা এবং পিছনের টা নামার কাজে ব্যবহৃত হয়। যাত্রী ওঠার পথে রাখা QR কোড মোবাইলে স্ক্যান করে, ব্যাংক কার্ড পাঞ্চ করে বা নির্দিষ্ট বক্সে টাকা রেখে ভাড়া পরিশোধের ব্যবস্থা আছে। প্রতিটা বাসে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ টা ক্যামেরা আছে যেগুলোর মাধ্যমে সমস্ত যাত্রীদের ওঠানামা, ভাড়া পরিশোধ, চালকের সতর্কতা সার্বক্ষণিক কর্তৃপক্ষ তদারকি করেন। বাসে ওঠার পরেই সিটে বসার জন্য কেউ হুড়োহুড়ি করেনা বরং সবাই দাঁড়িয়ে থাকতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
 |
অত্যাধুনিক সব বিলাসবহুল পাবলিক বাসের একাংশ |
মাটির নিচে আছে আরেক পৃথিবী সেখানে মেট্রোরেল গুলো প্রতি ৫ মিনিট পরে পরে ঘুরে আসছে। খুব অল্প সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে মেট্রোরেলের জুড়ি মেলা ভার। কর্মস্থল থেকে বাসা শত শত মাইল দূরে হলেও মেট্রোরেলের সাহায্যে খুব সহজেই নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে পৌছে যাওয়া যায়। প্রতিটা মেট্রোরেলের প্রবেশদ্বার, বের হওয়ার পথে সার্বক্ষণিক চলন্ত সিঁড়ি, পায়ে হেঁটে নামার সিঁড়ি, পাশাপাশি শারীরিক প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার নিয়ে ওঠা নামার সুবিধা সহ শীততাপ নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে প্রতিটা মেট্রো স্টেশনে টিকিট কাটা থেকে শুরু করে বের হয়ে আসার আগ পর্যন্ত আছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ছোয়া। কোনরকম ঝুক্কি ঝামেলা ছাড়া নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য মেট্রোরেল ব্যবহার করা যাত্রীর সংখ্যা অন্যান্য গনপরিবহনের যাত্রীর সংখ্যার চেয়ে ঢের বেশি।
 |
সুসজ্জিত মেট্রোরেলের ভ্রমনের খন্ডচিত্র |
রোড এন্ড হাইওয়েঃ রাস্তাগুলো প্রায় সবজায়গাতেই ৮ লেনের। প্রত্যেক রাস্তাতেই ই-বাইক, সাইকেল চালানোর আলাদা লেন সহ পায়ে হেঁটে চলার ব্যবস্থা আছে। সব হাইওয়ে গুলো এক্সপ্রেস ওয়ের আদলে তৈরী, মানে কোথাও গাড়ী না থামিয়ে নির্দিষ্ট লেন ধরে শয়ে শয়ে মাইল উচ্চ গতিতে যাওয়া যায়। হাইওয়ের কিছু কিছু জায়গায় টোল দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। টোল গেট গুলো আসার মাইল খানিক আগেই চালকের মোবাইলের এপসে সিগন্যাল দেয় এবং টোলের ভাড়া মোবাইলে পরিশোধ করলেই গাড়ী গেটে আসার কিছুটা আগেই নিজ থেকেই খুলে যায়। যাতে করে ওখানে আসার পরে সময় নষ্ট না হয়। চীনের হাই স্পিড (বুলেট ট্রেন) ট্রেনের কথা সবারই জানা। যেটাতে রওনা হয়ে মানুষ বিমানের মত দ্রুত গতিতে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে পারে। এদের এখানে আলাদা ভাবে কোন বর্ষা মৌসুম না থাকায় গ্রীষ্মের চেয়ে শীতের দিনে বৃষ্টির আধিক্য দেখা যায়, সেজন্য গ্রীষ্ম মৌসুমে হাইওয়ে সহ সমস্ত রাস্তা ঘাটে বেশি ধুলো ময়লা জমে। এই ধুলো ময়লা পরিস্কার করার জন্য সবখানেই অত্যাধুনিক কিছু গাড়ী আছে। গাড়ী গুলোর সাহায্যে রাতের শেষ প্রহরে সমস্ত রাস্তা ঘাট ধুয়ে মুছে এমনভাবে পরিস্কার করে দেখলে মনে হবে রাস্তা গুলো এইমাত্র তৈরি করা হয়েছে। রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের ঝরা পাতা বা অন্যান্য ময়লা আবর্জনা পরিস্কারের জন্য সেন্সরের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয় ভাবে চলা কিছু মেশিন আছে, সেগুলো কোন চালক বা অন্য কারো সাহায্য ছাড়া নিজ থেকেই আপন মনে রাস্তা পরিস্কার করে চলে। ভোরের আলো ফোটার আগেই এসব কাজ গুলো সম্পন্ন হয়।
 |
খুব অল্পদিনের ভিতরেই সুউচ্চ কংক্রিটের পাহাড় কেটে বানানো এই রাস্তা |
কংক্রিটের সুউচ্চ পাহাড় কেটে তার ভিতর দিয়ে চলে গেছে মাইলের পর মাইল টানেল (গাড়ি যাওয়ার রাস্তা), মেট্রো রেলের লাইন এবং সর্বোপরি পাহাড় কেটে অত্যাধুনিক আবাসান বানানোর চিত্র সবসময় চোখে পড়ে। একদিন পথে যেতে যেতে দেখতে পেলাম পাহাড়ের তলদেশে ডিনামাইটের বিশাল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাহাড় কাটার কাজ শুরু হয়েছে এবং মাস দুই পরে সেই সুউচ্চ কংক্রিটের পাহাড় কেটে পরিস্কার করে সেখান থেকে চলে গেছে দৃষ্টিনন্দন রাস্তা। কোন এলাকায় জনবসতি গড়ে তুলতে চাইলে আগে থেকে জনগণের সমস্ত চাহিদা যেমন রাস্তা-ঘাট, বাজার, পানি-বিদ্যুৎ লাইন, যোগাযোগের যথাযথ ব্যবস্থা শেষ করেই তারপরে সেখানে মানুষ বসবাসের অনুমতি মেলে। নির্মাণ কাজের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায় খুবই কম সংখ্যক শ্রমিকের উপস্থিতিতে অত্যাধুনিক সব বিশালাকৃতি যন্ত্রের সাহায্যে অল্প সময়ের ভিতর সুউচ্চ অট্টালিকা, দীর্ঘ সেতু, দৃষ্টি নন্দন হাইওয়ে সহ নজর কাড়া সব স্থাপত্য তৈরি হচ্ছে। নদীর পাড় গুলো বড়বড় কংক্রিটের পাথর দিয়ে এত সুন্দর ভাবে বাঁধানো যে হাজার বছরেও সেগুলো কিছু হওয়ার নয়। প্রতিটা নদীর পাড় দিয়ে চলে গেছে দৃষ্টিনন্দন সবুজ অরণ্যে ঘেরা অত্যাধুনিক পার্ক এবং মানুষের হাঁটার রাস্তা।
 |
সব নদীর পাড় গুলো এমন কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো কয়েক স্তরের বাঁধ |
সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরার আওতায়ঃ চুরি-ছিনতাই, বাটপারি, ব্লাকমেইল ছোট বড় যেকোন অপরাধ করে এখানে কেউ রেহায় পায়না তাই ওগুলো সংঘটিতও হয়না। হবে কি করে? প্রতিটা মানুষের প্রতিটা পদক্ষেপ ক্যামেরায় রেকর্ডিং হচ্ছে। নিজের বাসা থেকে বের হয়েই আপনি ক্যামেরায় ট্রাকিং হতে থাকবেন আর সেটা চলবে যতক্ষণ না আবার আপনি বাসায় ফিরছেন ততক্ষণ। কোথায় নেই ক্যামেরা? প্রতিটা অলিগলি, মাঠ, পাহাড়, নদীর কিনারা, পার্ক, সুপার মল সবখানেই ক্যামেরা আপনাকে ডিটেক্ট করবে। পৃথিবীর অন্যন্য উন্নত দেশে এত ক্যামেরা ট্রাকিং সিস্টেম আছে কিনা আমার জানা নেই। তাই এখানে কারো কোন জিনিস হারানো গেলে সেটা খুজে বের করা যত সহজ সাথে মানুষের নিরাপত্তাও পুরোপুরি নিশ্চিত। সবজায়গাতেই মানুষের চলাচল নিরাপত্তার চাঁদরে ঘেরা এবং কোন রকম অস্ত্রের ব্যবহার ছাড়াই নিরাপত্তার বাহিনীর সদস্যদের (পুলিশ, সেনাবাহিনী) টহল চোখে পড়ে। সেজন্য একজন মহিলাও এখানে রাত ১২ টার পরে আরামচে সাইকেল চালিয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফেরে।
 |
রাস্তা সহ সমস্ত অলিগলিতে সেট করা অত্যাধুনিক এসব ক্যামেরা আপনার চলাফেরাকে সার্বক্ষণিক রেকর্ড করবে |
কেনাকাটাঃ শ্রমিক থেকে উচ্চবিত্ত সবাই স্মার্ট ফোন (আইফোন, স্যামসাং, অপ্প, হুয়াউয়ে) ব্যবহার করে। কাছে একটা ফোন থাকলে কেনাকাটা বা দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য আর কোন কিছুর দরকার পড়ে না কারন এখানে ক্যাশ টাকার কোন লেনদেন নেই বললেই চলে। তাই সেটা যত বড় বা ছোট পরিমানের লেনদেন হোক না কেন। সরাসরি ব্যাঙ্কের সাথে যুক্ত উইচ্যাট (চাইনিজদের সর্বাধিক ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম), আলি-পে (আলিবাবা পরিচালিত) এপস এর মাধ্যমে সমস্ত কেনাকাটা কোন ঝামেলা ছাড়াই মোবাইল ফোনে হয়ে যাচ্ছে। এই দুটো মোবাইলের এপস এর কথা একটু আলাদা ভাবে বলতেই হয়। এমন কোন দরকারী কাজ নেই যে এই এপস দুটোর সাহায্যে করা যায় না। যেকোন পরিবহনের (বিমান থেকে ট্যাক্সি) অগ্রিম টিকিট বুকিং, হোটেল বুকিং, রেস্টুরেন্টে সিট বুকিং, প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় আর্থিক লেনদেন সহ অন্যান্য অনেক সুবিধাদি, এছাড়া সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে সহজ এবং জনপ্রিয় মাধ্যম সহ যেকোন সময় যেকাউকে যেকোন পরিমান তাৎক্ষনিক আর্থিক লেনদেনের নির্ভরযোগ্য দুইটি এপস হচ্ছে উইচ্যাট এবং আলিপে। প্রতিটা চীনা নাগরিকের এই এপস দুটো ব্যবাহারের মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনকে অনেক বেশি ছন্দময় এবং সহজ করে দিয়েছে।
 |
রাস্তার পাশে সুসজ্জিত ভাবে সাজানো ব্যাটারী চালিত ই-বাইক |
অনলাইন শপিং বা অন্যান্য যেকোন কেনাকাটা করার জন্য শুধু একটা মোবাইল ফোনই যথেষ্ট এবং এর ফলে যে সুবিধাগুলো আছে সেটা হলঃ নেই টাকা ভাংতির ঝামেলা, ছেড়া অচল এবং জালটাকার ঝুক্কি, সর্বপরি মানিব্যাগ নেওয়ার ঝামেলা। টাওবাও, টিমল, ফিনদউদউ, জে ডি ডট কম নামে কিছু অনলাইন শপ আছে যেগুলোর মাধ্যমে ঘরে বসে সুই থেকে শুরু করে প্রাইভেট কার ও কেনা যায়। ঘরে বসে অর্ডার করার এক থেকে দুই তিন দিনের ভিতর (নির্ভর করে অর্ডারকৃত দোকানের দূরত্বের উপর) ডেলিভারি পাওয়া যায়, নেই কোন দরদামে ঠকার ভয়। কারন দাম যাচাই করে এবং গুণগত মান দেখে কেনা যায়। ডেলিভারি পাওয়ার পর ক্রয়কৃত মালামালে কোন ত্রুটি (পরিবহণ জনিত কারণে ভেঙে যাওয়া বা পণ্যের গুণগত মানের পরিবর্তন হলে) থাকলে সেটা বিনা পয়সায় পরিবর্তন অথবা টাকা ফেরত নেওয়ার সুযোগ আছে। সুপার মল থেকে শুরু করে ছোটখাট প্রায় সব রকমের দোকানের হোম ডেলিভারি দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। তাই সকালের নাস্তা, দুপুরের এবং রাতের খাবার থেকে শুরু করে যেকোন প্রয়োজনীয় জিনিস মোবাইলে অর্ডার করার পরপরই খুব অল্প সময়ের মধ্যে আপনার বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রত্যেক দোকানের কিছু কর্মী নিয়োজিত আছে।
সবরকমের ইন্টারনেট ডাটা এখানে অনেক সাশ্রয়ী হওয়ায় যেকেউ সহজে ভালো মানের ফাইভ জি (5G) নেটওয়ার্ক সেবা পেয়ে থাকে। ২৯ ইউয়ান অর্থাৎ দেশী টাকায় ~৩৫০ (আমি উক্ত প্যাকেজ ব্যবহার করি, অন্যান্য ক্ষেত্রে সামান্য কিছু কম বা বেশি হতে পারে) এর প্যকেজ দিয়ে সারামাস নির্বিঘ্নে আনলিমিটেড ফোন কল এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। কারণ ডিজিটালাইজড সবকিছুকে সবার নির্বিঘ্নে উপভোগ করার জন্য সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট সেবা অতীব জরুরী।
 |
সব সবজি গুলোর এমন বাম্পার ফলন চোখে পড়ে |
চাইনিজ কৃষিঃ কৃষিতে এদের অভিনব সাফল্য। পরিসংখ্যান ঘাটলে দেখা যায় সীমিত চাষযোগ্য কৃষি ভূমি নিয়ে এই বিশাল জনসংখ্যার দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা মেটানো খুবই কঠিন এবং চ্যালেঞ্জের। তাই বাধ্য হয়েই কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের উন্নত কৃষি নির্ভর পদ্ধতি এদের অনুসরণ করা লাগে। কৃষি জমি প্রস্তুত, বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল কেটে প্যাকেটজাত করা সবটায় আধুনিক যন্ত্রপাতির ছোয়ায় খুবই সহজে হয়ে যাচ্ছে। চাহিদার তুলনায় চাষ যোগ্য কৃষি জমির অপ্রতুলতার কারনে বাধ্য হয়ে এরা হাইব্রিড শাকসবজি চাষ করে। একবার আমাদের পাশের একটা কৃষি ফার্মে গিয়ে দেখেছিলাম সব সবজি গাছ গুলোতে বাম্পার ফলন, সবজির ভারে গাছগুলোর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ক্ষমতা টুকু নেই। কৃষি জমি থেকে শুরু করে সব জমাজমি সরকারের তত্ত্বাবধায়নে থাকে, সরকার থেকে নির্দিষ্ট সময়ের লিজ নিয়ে তবেই কৃষক সহ অন্যান্য জনগণ ব্যবহারের অনুমতি পায়। সেজন্য জমাজমি নিয়ে কারো ভিতর কোন বিরোধ নেই।
 |
চাইনিজ সবজি বাগানের একাংশ |
পরিবেশ বান্ধব ই-বাইক, সাইকেল, প্রাইভেট কারঃ রাস্তার দুইপাশ দিয়ে রাখা আছে বিভিন্ন কোম্পানির প্রদান করা সারি সারি ই-বাইক, সাইকেল আর প্রাইভেটকার। সবগুলোই সেলফ সার্ভিস মানে নিজেদের ড্রাইভ করতে হবে, মোবাইলের এপসের মাধ্যমে পরিবহনের গায়ে লাগানোQR কোর্ড স্ক্যান করলেই স্বয়ংক্রিয় ভাবে লক খুলে যায়। তারপর পথচারী নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছিয়ে সেগুলোকে আবার লক করে রাখে এবং যাতে করে অন্য যেকেউ আবার সেটাকেপুনরায় ব্যবহার করতে পারে। প্রাইভেট কার ও একই ভাবে রাস্তার পাশে নির্দিষ্ট স্থানে পার্ক করে রাখা আছে, যারা ফ্যমিলি সহ একটু দূরে কোথাও যেতে চায় তাদের ক্ষেত্রে এটা খুবই উপযোগী। তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকা লাগবে।
 |
রাস্তার দুপাশ দিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে রাখা আছে এসব সাইকেল |
পাবলিক বাস, ব্যাক্তিগত গাড়ী, ই-বাইক, সাইকেল এর অধিকাংশই ব্যাটারী চালিত অর্থাৎ পরিবেশ বান্ধব। প্রতিটা কোম্পানির বেশ কিছু কর্মী আছে, তারা এপসের মাধ্যমে জানতে পারেন সাইকেল বা গাড়ীগুলো কোথায় রাখা আছে। তাদের মাঝরাতের ডিউটি হল, প্রতিটা সাইকেল, ই-বাইক, গাড়ীগুলো আবার জনবহুল এলাকার নির্ধারিত স্থানে রেখে যাওয়া এবং ব্যাটারী পরিবর্তন করে ফুল চার্জের ব্যাটারী দিয়ে যাওয়া। যাতে করে অফিস টাইমে পথচারীরা সবাই পর্যাপ্ত সংখ্যক পরিবহন হাতের কাছে পায়। এগুলোর ভাড়াও খুব কম এবং স্ক্যান করার পর থেকেই ভাড়া কাটা শুরু করে আর লক করলেই বন্ধ হয়। সাইকেল, ই-বাইকের ক্ষেত্রে ঘন্টায় ১-২ ইউয়ান এর মত আর গাড়ীর ক্ষেত্রে সেটা দূরত্ব ও সময়ের উপর নির্ভর করে।
 |
রাস্তার পাশ দিয়ে অল্প দুরুত্ব পরপর নির্দিষ্ট স্থানে রাখা সেলফ সার্ভিস প্রাইভেটকার |
কর্মক্ষেত্রে নারীরাঃ রাস্তায় বা বিভিন্ন শপিং মলে সবখানে মহিলাদের আধিক্ষ্য দেখা যায়, এগুলো দেখলেই সহজেই আচ করা যায় এখানে মহিলারা অনেক বেশি কর্মক্ষম। সমস্ত দোকান পাট, বড় বড় শপিং মল, বাস, ট্রাক, মেট্রো সবকিছু মহিলাদের তত্ত্বাবধায়নে চলে। নির্মাণ কাজের শ্রমিক হিসাবেও পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অধিক উপস্থিতি লক্ষনীয়। একজন মহিলা যখন কয়েক টন মালামাল সহ বিশাল আকৃতির ট্রাক নিজ হাতে দক্ষতার সাথে চালনা করে নিয়ে যায় তখন সহজেই অনুমেয় মহিলারা এখানে কতটা কর্মক্ষম।
 |
বিনোদনের জন্য পার্ক গুলোতে আছে বাচ্চাদের ফ্রি রাইড |
পাবলিক পরিবহন এবং পাবলিক প্লেসে (পার্কসহ বিভিন্ন ঘোরার জায়গা) কোথাও হকারস দেখতে পাওয়া যায়না। কোথাও কোন ভিখারি চোখে পড়েনি তবে মাঝেমধ্যে রাস্তার পাশে জনবহুল কিছু এলাকায় শারীরিক ভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র (ভায়োলিন, বাঁশি ইত্যাদি) বাজিয়ে বা নিজের গলায় স্পিকারে গান করতে দেখেছি। কারও মনে চাইলে তাদের সামনে রাখা QR কোর্ড মোবাইলে স্ক্যান করে কিছু টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছে।
 |
হাটার জন্য সব পার্কে আছে সবুজে ঘেরা দৃষ্টিনন্দন রাস্তা |
দেশকে উন্নতির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে যেটা সবচেয়ে বেশি উপযোগী সেটা হল রিসার্চ এবং টেকনোলজি এবং এটাতে ও চীনারা এখন বিশ্বের মধ্যে এক নাম্বারে অবস্থান করছে। একজন গবেষক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক কে এরা অনেক বেশি মূল্যায়ন করে। প্রায় সর্বক্ষেত্রেই বেশিরভাগ উন্নত দেশকে টপকে যাওয়া চীনের এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
 |
নদীর পাড় গুলোর পাশ দিয়ে চলে গেছে পায়ে হেঁটে চলার রাস্তা |
কিছু খারাপ দিকের ভিতরে এরা সারাক্ষনই মোবাইলে বিজি থাকে, সেটা রাস্তা পারাপার, গাড়ি চালানো, খাওয়া বা অন্য যেকোন সময় হতে পারে। ইংরেজি প্রয়োজন না হওয়ায় এরা খুব কমই ইংরেজি পারে কারন ছোট থেকে এদের ইংরেজি শেখানো হতনা (বর্তমানে ভিন্ন) তাই ইংরেজির স্তরটা এদের অনেক নিচে। সমস্ত সফটওয়্যার, এপস সবকিছু নিজেদের ভাষায় ব্যবহার উপযোগী, এজন্য এসবের কোনকিছুতে এদের ইংরেজির দরকার পড়ে না। সামান্য হাই-হেলো, ইয়েস-নো বলার মতও ইংরেজি বেশিরভাগ লোকের জানা নেই। সেজন্য চাইনিজ ভাষা না জেনে বিদেশী নতুন কেউ আসলে প্রথম প্রথম তাকে একটু বিপাকেই পড়তে হবে। চীনে গুগল ব্যবহারে অনুমতি নেই, তাই যেকেউ এখানে আসলে গুগল বা গুগলের কোন এপস (ফেসবুক, জিমেইল, গুগল স্কলার, প্লে স্টোর ইত্যাদি) ব্যবহার করতে পারেনা। সেক্ষেত্রে VPN ব্যবহার করে দরকারী গুগল সম্পর্কিত কাজ সেরে নিতে হয়।
কর্মসংস্থানের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঘুষ, দুর্নীতি, ব্যক্তি স্বার্থের চিন্তা যেকোন দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় গুলোর মধ্যে অন্যতম বলে আমার মনে হয়। চীন বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল আমাদের ভূখণ্ডের খুবই কাছে অবস্থিত প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে একটি রাষ্ট্র। আমাদেরও আছে বিপুল জনশক্তি, অপার সম্ভবনাময় ভবিষ্যৎ তাই আমরাও একদিন পাশ্চত্যসব উন্নত দেশের মত উন্নত থেকে উন্নত তর বিশ্বের দিকে এগিয়ে যাব এ আশাটুকু করতেই পারি। সকলের শুভ কামনায়।
লেখকঃ অজয় কান্তি মন্ডল
গবেষক
ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এবং ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি
ফুজিয়ান, চীন।