যশোরে খাদ্য গুদামের ১৫ লাখ নতুন বস্তার পরিবর্তে পুরাতন বস্তা কিনে সাত কোটি টাকা লোপাট




সুমন হোসেন, যশোর জেলা প্রতিনিধি। 
ধান চাল সংগ্রহের জন্যে ১৫ লাখ নতুন বস্তার পরিবর্তে পুরাতন বস্তা কিনে সাত কোটি টাকা লোপাট করেছেন যশোর সদর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশরাফুজ্জামানসহ একটি চক্র। এ ঘটনায় তাকে তেরখাদা উপজেলায় শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে। আজ ২৭ জুলাই আশরাফুজ্জামানকে যশোর ছাড়তে হবে, অন্যথায় ২৮ জুলাই থেকে কর্মবিমুক্ত বলে গণ্য হবেন।অভিযোগ আছে, এই লুটপাটে আশরাফুজ্জামান একাই পকেটে ভরেছেন পাঁচ কোটি টাকা। বাকি দু’কোটি টাকার ভাগ পেয়েছেন আয়ান জুটমিল ও বিভিন্ন গুদাম কর্তারা।খাদ্য বিভাগের ইতিহাসে এটি বড় ধরনের দুর্নীতি বলে জানিয়েছেন খোদ খাদ্য বিভাগের অনেক কর্মকর্তা। এ ব্যাপারে দু’দফা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর অভিযুক্ত খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা দাপুটে সিবিএ নেতা আশরাফুজ্জামানকে শাস্তিমূলক বদলি করা হলেও তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগদানে টালবাহানা করে আসছেন। তবে যশোর গুদামে আজ তার শেষ দিন বলে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহবুবুর রহমান।খাদ্য বিভাগের একধিক সূত্র জানিয়েছে, যশোর সদর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশরাফুজ্জামান খাদ্য পরিদর্শক সমিতির খুলনা বিভাগীয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি খুলনার আয়ান জুট মিল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগসাজস করে ১৫ লাখ পুরাতন বস্তা নিয়ে তা বিভাগের বিভিন্ন জেলার খাদ্য গুদামে প্রতিস্থাপনের সুযোগ করে দেন। এর মধ্যে দুই লাখ বস্তা আগে একবার ব্যবহার করা হয়েছিল। বাকি ১৩ লাখ বস্তা ব্যবহার করা না হলেও তা ২০১৪ সালের লোগো সম্বলিত। এই ১৫ লাখ পুরাতন বস্তা চালিয়ে আশরাফুজ্জামান হাতিয়েছেন প্রায় ৫ কোটি টাকা। চলতি বছরে বোরো ধান-চাল সংগ্রহ উপলক্ষে এ বস্তা খুলনা বিভাগের বিভিন্ন খাদ্যগুদামে কাজে লাগানো হয়েছে।গত ৪ জুলাই যশোর সদর খাদ্য গুদামে নতুন বস্তা সরিয়ে পুরাতন বস্তা মজুদ করা হচ্ছে এমন একটি অভিযোগ খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অবগত হন। তিনি খুলনার আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহবুবুর রহমানকে তদন্তের নির্দেশ দেন। আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ৫ জুলাই ঢাকা থেকে বিমানযোগে যশোর পৌঁছান। সকাল ১০ টায় তিনি যশোর সদর গুদামে উপস্থিত হন। এর আগে সকালে খুলনা থেকে সহকারী রসায়নবিদ ইকরামুল কবীর সেখানে উপস্থিত ছিলেন। যশোর ৬নং গুদামের বস্তার মজুদ পরীক্ষা করে পুরাতন বস্তা চটের মোড়কে লোহার পাত দিয়ে বেল করা দেখতে পান। প্রতিটি বেলে ৪শ’ পিস বস্তা। যার সবই ছিল পুরাতন এবং ব্যবহৃত। একই অবস্থা শংকরপুর ২ নং ক্যাম্পাসের গুদামে। সূত্রের দাবি, সরকার কর্তৃক চাল ধান সংগ্রহ কাজে ব্যবহারের জন্য মিল থেকে নতুন ১৫ লাখ বস্তা প্রতিটি ৭৯/ টাকা দরে ক্রয় করা হয়েছে। যার দাম ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ওসিএলএসডি নতুন বস্তা না নিয়ে মিলারের সাথে যোগসাজসে পুরাতন বস্তা গুদামে গ্রহণ করেছেন। যার দাম তিন কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এ ঘটনায় চক্রটি সাত কোটি টাকা বাণিজ্য করেছে। এর আগে জুন মাসের শেষার্ধে ৩টি বস্তার ট্রাক গুদামে আনলোডের জন্য আসে। শ্রমিকরা বস্তা খালাসের সময় দেখতে পান বস্তা পুরাতন এবং একাধিক বার ব্যবহৃত। উপস্থিত শ্রমিক, চালকল মালিক এবং ডিলার, ত্রাণের খাদ্যশস্য গ্রহণকারী জনপ্রতিনিধিদের প্রবল আপত্তির মুখে বস্তা খালাস বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু ট্রাক ফেরত পাঠানো হয়নি। ৩ দিন পর সন্ধ্যায় বস্তা আনলোড করা হয়। এভাবে একের পর এক পুরাতন বস্তার ট্রাক আসতে থাকে। ওসিএলএসডি বিভিন্ন মিলে সংগ্রহের জন্য এই বস্তা দিয়েছেন। সমঝোতার ভিত্তিতে কিছু বস্তা ঝিকরগাছা এবং নাভারণ এলএসডিতে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া পুরাতন ত্রাণের চাল সংগ্রহ দেখিয়ে বিভিন্ন খামালের মধ্যে রাখা আছে। চারিপাশে নতুন চালের বস্তা দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বাইরে থেকে বুঝা যায় না। আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক বস্তা পরীক্ষা করে এলএসডিতে লাঞ্চ সেরে খুলনা ফিরে যান। খুলনা ফিরে তিনি ৩ সদস্যের একটি কমিটি করেন। কমিটির আহবায়ক খুলনা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তানভীর হোসেন, সহকারী রসায়নবিদ সদস্য ইকরামুল কবির এবং কারিগরী টিসিএফ হাফিজুর রহমান। কিন্তু ধুরন্ধর আশরাফুজ্জামান কমিটিকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। যে কারণে কমিটি তদন্তে কালক্ষেপণ করে এক সপ্তাহ পরে তদন্তে আসেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ওসিএলএসডি এবং ধুরন্ধর উপ খাদ্যপরিদর্শক আলাউদ্দিন বিশ্বাস অনেক বস্তা চালকলে সরবরাহ করেন। একটি ট্রাক ৫০ বেল বস্তা লোড দিয়ে ২ দিন পর কেশবপুর পাঠিয়ে দেন কোনো কাগজপত্র ছাড়াই (ট্রাক নং যশোর ট-০২৩৪ চালক রেজাউল)। শুরু থেকেই বস্তার মান নিয়ে অনেক লুকোচুরি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পুরাতন বস্তা চিহ্নিত হওয়ার পরেও সময়ক্ষেপণ করে বস্তা পাল্টানো কিংবা রাইস মিলে সরবরাহ করে আলামত লোপাটের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। একইভাবে পুরাতন চাল আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, খুলনার আয়ান জুট মিলের সাথে যশোর সদর ওসিএলএসডি আশরাফুজ্জামানের সাথে ১৫ লাখ বস্তা খুলনা বিভাগের বিভিন্ন কেন্দ্রে সরবরাহ করার জন্য ডিল হয়। আশরাফুজ্জামান পরিদর্শক সমিতির নেতা হিসেবে সকল ওসিএলএসডিকে বলে দেন নিম্নমানের বস্তাগুলো গ্রহণ করে দ্রুত চলমান সংগ্রহ কাজে ব্যবহার করার জন্য। খুলনা বিভাগে আয়ান জুট মিল থেকে যত বস্তা সরবরাহ করা হয়েছে তার একটিও মানসম্মত ছিল না। কিছু বস্তা ব্যবহৃত পুরাতন। কিছু বস্তা অব্যবহৃত, তবে সেগুলোও পুরাতন। বস্তার গায়ে লাগানো ছাপ তার বড় প্রমান। চুক্তিপত্র অনুযায়ী সরবরাহ আদেশের সালে উৎপাদিত হতে হবে। কিন্তু ৩০ কেজির বস্তায় উৎপাদন সাল 
২০১৩/১৪ সালের ছাপ দেয়া আছে। এ বছরে উৎপাদিত বস্তার গায়ে ৬/৭ বছর আগের ছাপ নিশ্চয় কেউ লাগাবে না। তদন্ত যশোর এলএসডি কেন্দ্রিক ৫০ কেজির ১ লাখ বস্তার হিসেব মিলিয়েছেন, ৩০ কেজির মানহীন বস্তার হিসাব অতটা গুরুত্ব দেননি। করোনার কারণে কর্মকর্তাদের চলাচল সীমিত হওয়ার কারনে ওসিএলএসডিগণ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন। যশোর জেলার অপর দুই সুবিধাভোগী নাভারণ এবং ঝিকরগাছা ওসিএলএসডির বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ঝিকরগাছা এলএসডিতে কিছুদিন আগে দত্তনগর এলএসডি থেকে 
আমন চাল আসে। এতে ২/১টি বস্তায় বিনির্দেশ বহির্ভূত চাল থাকায় তিনি ট্রাক দাঁড় করিয়ে রেখে চাল পরিবর্তন করিয়ে তবে আনলোড করেছেন। অথচ পুরাতন বস্তা আনলোড করার সময় কোন উচ্চবাচ্য হয়নি। এমনকি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়নি। অনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একই কাজ নাভারণ ওসিএলএসডি করেছেন। কিন্তু রহস্যজনকভাবে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণে বিরত থেকেছেন। কিছু বান্ডিলে খারাপ থাকলে অগোচরে হতে পারে। এরপরও করোনা সংকটের মধ্যে তদন্ত কমিটি যেটুকুই তদন্ত করেছেন, তারমধ্যে অসংগতি ও সরকারকে ঠকিয়ে আশরাফুজ্জামান নিজে লাভবান হয়েছেন এমন নানা প্রমাণ পেয়েছেন। একই সাথে এই বস্তা কেলেংকারির সাথে আরও কয়েকজন অফিসার ও আয়ান জুট মিল কর্তৃপক্ষের যোগসূত্রতা রয়েছে। যে কারণে এসব ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেন তদন্ত কমিটি। আশরাফুজ্জামান তদন্ত কমিটিকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে তার সাময়িক রবখাস্ত আদেশ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। আঞ্চলিক খাদ্যনিয়ন্ত্রক তাকে শাস্তিমূলক বদলি করেন। গত ১৯ জুলাই এক আদেশে ওসিএলএসডি সদর আশরাফুজ্জামানকে প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে তেরখাদা উপজেলায় বদলি করা হয়। আর যশোরে দেয়া হয়েছে আবুল কালাম আজাদকে। কিন্তু বদলির আদেশের পরও তিনি টালবাহানা ও নানামুখি দেনদরবারে লিপ্ত রয়েছেন। নিজের সিবিএ দাপট দেখানোর চেষ্টা করে চলেছেন। এ ব্যাপারে খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ওই বস্তা কেলেংকারি ঘটনায় জুট মিল, রাইসমিলসহ আরো কয়েকটি ইউনিটের যোগসূত্রতা রয়েছে। তদন্ত কমিটি যশোর সদর ওসি এলএসডিসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়েছে। আর আরশাফুজ্জামানের অনিয়ম অসংগতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে বদলি করা হয়েছে। ২ বছরের আগে গুদামের দায়িত্ব পরিত্যাগ শাস্তিমুলক বদলিই বলা যেতে পারে। প্রশাসনিক কারণে তাকে বদলি করা হয়েছে এমন আদেশ দেয়া হয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী সংবাদ
পরবর্তী সংবাদ