১৯২০ সালে এক মহানায়কের জন্ম

১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গােপালগঞ্জ জেলার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক অবস্থাপন্ন পরিবারে রােজ মঙ্গলবার ৩রা চৈত্র ১৩২৭ বঙ্গাব্দ এবং ইংরেজী ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই মার্চ বাদ মাগরেব (রাত ৮টা) যে শিশুর জন্ম হয়, পরবর্তীকালে তিনিই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্রষ্টা এবং বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা মােসাম্মৎ সায়েরা বেগম। শেখ মুজিব পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান; তবে প্রথম পুত্র ৪ বােন এবং ২ ভাই। শেখ মুজিবের ডাক নাম "খােকা"। বাবা-মা দু'জনেই তাদের বড় ছেলেকে এই আদুরে 'খােকা' নামে ডাকতেন। বাড়ীতেই তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। গৃহশিক্ষকের নাম পণ্ডিত সাখাওয়াৎ উল্লাহ। ১৯২৭-১৯২৯ সাত বছর বয়সে শেখ মুজিবের স্কুল শিক্ষার সূচনা হয়। গমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরে তিনি গােপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন ১৯২৯ সালে। ১৯৩১ এ সময় শেখ লুৎফর রহমান সরকারি চাকুরীজীবী। মাদারীপুর দেওয়ানী আদালতে তিনি ছিলেন সেরেস্তাদার। প্রায়ই গ্রামের বাড়ী টুঙ্গিপাড়ায় যাতায়াত করতেন। ১৯৩১ তিনি দুরন্ত স্বভাবের পুত্র শেখ মুজিবুরকে সঙ্গে করে কর্ম ক্ষেত্রে নিয়ে এলেন এবং ভর্তি করে দিলেন মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে কিন্তু বছর দেড়েকের মধ্যে হ্যাংলা ও ছিপছিপে শেখ মুজিব আক্রান্ত হলেন 'বেরিবেরি রােগে এবং এই রােগ থেকেই তাঁর চোখে দারুণ অসুখ দেখা দিলাে। ডাক্তারী ভাষায় রােগের নাম "গ্লোকুমা" বছর কয়েকের জন্য মুজিবের লেখাপড়া একেবারে বন্ধ। ১৯৩৬ বন্ধু-বান্ধব এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে সুচিকিৎসার জন্য পুত্রকে সঙ্গে করে লুৎফর রহমান কোলকাতায় গেলেন। বিখ্যাত চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডাঃ পি আহমদ কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেখ মুজিবের চোখে অস্ত্রোপচার করলেন। সফল অপারেশনের পর ডাঃ আহমদের পরামর্শেই কিশাের মুজিব চশমা ব্যবহার করতে শুরু করলেন। গােপালগঞ্জে ফিরে এসে তিনি ভর্তি হলেন খ্রীষ্টানদের পরিচালিত মিশন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে।
 
১৯৩৮ মাত্র ১৮ বছর বয়সে শেখ মুজিবের বিয়ে হয় ফজিলাতুন্নেসা ওরফে রেনুর সঙ্গে। এদের ৫টি পুত্র-কন্যা যথাক্রমে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। ১৯৩৯ শেখ মুজিব পরিণত হলেন একজন উন্নতমানের স্পাের্টসম্যান হিসেবে। তাঁর প্রিয়খেলা ফুটবল ও ভলিবল তবে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন গুরু সদয় দত্তের প্রবর্তিত ব্রতচারী নৃত্য'। এই ব্রতচারী থেকেই তাঁর মন মানসিকতায় বাঙালি চরিত্রের উন্মেষ ঘটে। ইতিমধ্যে শেখ মুজিব তার চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য ছাত্রদের নেতৃত্ব লাভ করেন। এবং স্থানীয় রাজনীতির চক্রান্তে দু'দফায় কারাবাস করেন। প্রথমবার ঘণ্টা কয়েক এবং দ্বিতীয়বার দিন সাতেকের জন্য। ১৯৪০ অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক এবং সরবরাহ বিভাগের মন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী একত্রে গােপালঞ্জ মিশন স্কুল পরিদর্শনে আগমন করলে ছাত্রদের দাবি দাওয়া নিয়ে শেখ মুজিব একাই তাঁদের মােকাবেলা করেন। অন্যতম দাবি ছিলাে অবিলম্বে ছাত্রাবাসের ছাদ মেরামত। মুজিবের একগুয়েমীর জন্য প্রধামন্ত্রী ফজলুল হক তাৎক্ষণিকভাবে ১২শ' টাকা মঞ্জুর করেন। সে বছর তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যােগদান করেন এবং অঙ্গদল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিলার নির্বাচিত হন।

১৯৪২
গােপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কোলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) আই, এ, ক্লাসে ভর্তি হন এবং মুসলিম লীগ রাজনীতিতে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৩ এ বছর শেখ মুজিব বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিলার নির্বাচিত হন। এর পরেই সমগ্র বাংলায় শুরু হয় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ'। নিরন্ন মানুষের সেবায় তিনি ঝাপিয়ে পড়লেন। অন্য ছাত্রদের সঙ্গে দল বেঁধে তিনিও লঙ্গড় খানায় স্বেচ্ছাসেবকের কাজে অংশগ্রহণ করলেন। উল্লেখ্য যে, তেতাল্লিশ-এর দুর্ভিক্ষে প্রায় ৫০ লক্ষ লােকের মৃত্যু হয়েছিল। ১৯৪৪ কুষ্টিয়ায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিব দুইটি  উপদলের মধ্যে প্রগতিশীল অংশের নেতৃত্ব গ্রহণে এগিয়ে আসেন। তিনি কোলকাতায়। অবস্থিত ফরিদপুর জেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদে নির্বাচিত হন।
 
১৯৪৫ 
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরিসমাপ্তি। ইংরেজ-ভারতের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা। সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে কেন্দ্র এবং প্রদেশগুলােতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। ১৯৪৬ শেখ মুজিব কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। এ বছর সাধারণ নির্বাচনে বেঙ্গল এসেমব্লীতে সােহরাওয়ার্দী হাশিমের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের দারুণ সাফল্য। ১১৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ১১৪টি – তে মুসলিম বিজয়ী ।  অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রীর পদে মুজিবের 'রাজনৈতিক গুরু' হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৬ই আগস্ট কোলকাতা মহানগরীতে শুরু হলাে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মুসলিম মহল্লাগুলােতে রাতে পাহারা দেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন ক্যাম্পে ত্রাণ-সাহায্য বিতরণে অন্যদের সঙ্গে শেখ মুজিবও অমানুষিক পরিশ্রম করলেন। ফলে এ বছর তিনি  বি, এ, পরীক্ষা পর্যন্ত দিতে পারলেন না।
 
১৯৪৭ কোলতাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেন। ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে কোলকাতায় দাঙ্গা প্রতিরােধ তৎপরতায় নির্যাতিত মুসলমানদের পাশে থেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ঠা জানুয়ারি মুসলিম ছাত্র লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ২৩ শে ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন আইন পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে' বলে ঘােষণা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে শেখ মুজিব এর প্রতিবাদ জানান। খাজা নাজিমউদ্দীনের বক্তব্যে সারাদেশে প্রতিবাদের, ঝড় ওঠে।
লেখকঃ মোঃ শাকিল আহমেদ। 
চৌহালী সরকারি কলেজ। 
চৌহালী, সিরাজগঞ্জ। 

সংবাদটি শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী সংবাদ
পরবর্তী সংবাদ