একজন ‘নাইনাই’ এর গল্প


অনলাইন শপিং চীনাদের জনপ্রিয় এবং স্বল্প সময়ে পণ্য ডেলিভারি পাওয়ার সর্বোত্তম পন্থা। যেখানে সার্বক্ষণিক নিশ্চিত করা হয় পণ্যের গুণগত মান। অনলাইনে পণ্য ক্রয় পরবর্তী, ক্রেতাকে যথাসময়ে ডেলিভারি দেওয়ার জন্য প্রতিটা কমিউনিটির আশপাশে বেশ কয়েকটি করে ডেলিভারি শপ আছে। পন্য অর্ডার করার পর হতে মোবাইলের অ্যাপে সেটার ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু আছে। এছাড়া কোন পন্য পৌঁছানোর সাথে সাথে ক্রেতার মোবাইল নাম্বারে খুদে বার্তা চলে যায়। তারপর ক্রেতারা গিয়ে নিজ দায়িত্বে নিজের পন্য খুঁজে নিয়ে আসে। ক্রেতাদের সহজে খুঁজে পেতে কর্তৃপক্ষ পণ্যের প্যাকেটের গায়ে নাম্বারিং করে নির্দিষ্ট র‍্যাকে সাজিয়ে রাখে। যেটা ক্রেতাদের চোখের নিমিষেই খুঁজে পেতে সাহায্য করে। ক্রেতারা নিজ দায়িত্বে সাজানো র‍্যাক থেকে পন্য নেওয়ার পর দোকানে রাখা স্ক্যানারে পন্যের গায়ের কিউ আর কোড/বার কোডটি স্ক্যান করে বাসায় নিয়ে যায়। কোডটি স্ক্যান করার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রেতা নিশ্চিত হয় যে, পন্য ক্রেতা ঠিকঠাক বুঝে পেয়েছে। 
চীনাদের মত আমরাও আমাদের দৈনন্দিন নিত্য প্রয়োজনীয় বেশীরভাগ জিনিসই অনলাইনে অর্ডার করি। প্রতিদিনই কিছু না কিছু পণ্য অনলাইন পণ্যের ডেলিভারি শপ থেকে নিয়ে আসতে হয়। আমার মেয়ে ‘অন্তু’র প্রতিদিনের আবদার থাকে তাকে সাথে নিয়েই যেন অনলাইনে ক্রয়কৃত পণ্য নিয়ে আসি। ক্রয়কৃত পন্য খুঁজে বের করে অন্তুর কাজ হল স্ক্যানারের নিচে রাখা। স্ক্যানারের নিচের নির্দিষ্ট স্থানে পন্যের বক্স রাখার পরেই স্ক্যানার স্বয়ংক্রিয় ভাবে পণ্যের বাক্সের গায়ে লাগানো কিউ আর কোড/বার কোড ডিটেক্ট করে স্ক্যানারটি চীনা ভাষায় রেকর্ড কৃত একটা কথা বলে। অন্তু এইটা শুনে খুব মজা পায়। সে ও মাঝেমধ্যে ওই রেকর্ড করা ভাষাটা অবিকল হুবুহ বলে। এরপর পণ্যটা নিয়ে বেরিয়ে আসার সময়ে গেটে অপেক্ষা করে নাইনাই। অন্তু পণ্য নিয়েই আগে নাইনাই কে খুজতে থাকে। এরপর নাইনাই এর কাছে গিয়ে বক্সটা দেয়। চীনা ভাষায় নাইনাই অর্থ ঠাম্মি বা দাদী। চীনা এই নাইনাই কে নিয়েই আজকের লেখা।
নাইনাই এর বয়স আনুমানিক আশি বছরের উপরেই হবে। বাহ্যিক অবলোকনে বোঝা গেলেও নাইনাই এর কাজকর্মে কেউ কখনো বুঝবে না যে উনি এত বয়স্কা একজন মহিলা। সবাই উনাকে নাইনাই বলেই ডাকে। তাই আমিও নাইনাই বলি আবার অন্তুও নাইনাই বলে। আমি যখন ভোরে হাঁটার জন্য বের হই মাঝে মধ্যে দেখি নাইনাই তার সকালের হাঁটার কাজ সেরে কমিউনিটির গেটে বসে আছে। সন্ধ্যার পরে বাসায় ফেরার সময় দেখি নাইনাই অন্যান্য বয়স্ক মানুষদের সাথে বসে গল্প করছে। খুবই প্রাণবন্ত আর মজার এই নাইনাই। নাইনাই এর রেগুলার ডিউটি অনলাইনের পণ্য ডেলিভারির দোকান খোলার সাথে সাথেই সেখানে হাজির হওয়া এবং বন্ধের আগ পর্যন্ত সেখানে থাকা। এরপর যারা পণ্য নিয়ে যায় তারা পণ্যের বক্সগুলো নাইনাই থেকে খুলে নেই। নাইনাই সেগুলো ছুরির সাহায্যে পরম যতনে খুলে বক্সটা নিজের কাছে রেখে পণ্যগুলো ক্রেতার কাছে দিয়ে দেয়। সবাই স্বঃপ্রনোদিত হয়ে নাইনাই কে দিয়েই বক্স গুলো খুলে নেই। এতে করে নাইনাই একটু লাভবান হয়। বক্সগুলোর কাগজ বিক্রি করে নাইনাই কিছু টাকা পায়। এই বক্সগুলোর এখানে বেশ চাহিদা। কেননা অনালাইন শপের কর্তৃপক্ষের প্রতিদিনকার লক্ষ লক্ষ বক্সের চাহিদা মেটাতে এসব বক্সগুলোর পুনঃ পুনঃব্যবহার করে। সেজন্য একটু দরিদ্র প্রকৃতির বয়স্ক মানুষেরা সেগুলো সংগ্রহ করে খুলে কাগজের মত ওজনে বিক্রি করেন। পরে সেগুলো দিয়ে বক্স বানিয়ে আবারো অনলাইনে পণ্য ডেলিভারির কাজে ব্যবহৃত হয়।   
গেল সপ্তাহের ছুটির দিন সকালে অন্তুকে নিয়ে কিছু পণ্য নিয়ে আসতে গেছিলাম। সেদিন নাইনাই আর ছাড়বেই না। পাশের দোকানে অন্তুকে নিয়ে গেছে। ওকে খাবার কিনে দেবেই তো দেবে। আগেও বেশ কিছুদিন নাইনাই বলেছে এ ব্যাপারে। কিন্তু তেমনটা সুযোগ করতে পারেনি। আমরা নাইনাই এর ভাষা বুঝিনা। হাতের ইঙ্গিতে বার বার না করতে লাগলাম। কিন্তু নাইনাই তার সিদ্ধান্তে অনড়। আগে অন্তুর কাছে জিজ্ঞাসা করেছে অন্তু কি পছন্দ করে। অন্তুও না বলেছিল, কিন্তু নাইনাই এর আদর ভালোবাসায় তার না বলাতেও কাজ হইনি। দোকান থেকে অন্তুর পছন্দের আইসক্রিম এবং সাথে কিছু চকলেট কিনে দিল অন্তুকে।
রাস্তা দিয়েই যেতেই মেইন রোডের পাশেই অনলাইন পণ্যের ওই দোকান। তাই আমরা আমাদের কমিউনিটি থেকে বাইরে বের হতে গেলেই নাইনাই এর দেখা পাই। নাইনাই এর নজর এড়ানো খুবই কষ্টকর। প্রতিদিন কয়েকবার আমাদের সাথে নাইনাই এর সাক্ষাৎ হয়। আমাদের দেখা মাত্রই কিসব বলা শুরু করে। ভাষা বুঝিনা তাই কিছুর প্রতিত্তর ও দিতে পারিনা। নাইনাই কে দেখি আর অনেক মায়া লাগে। মনে মনে ভাবি আহারে বয়স্কা মহিলাটা এভাবে এখানে সারাক্ষণ বসে থাকে। লোকের থেকে বক্স কুড়ায়। নাজানি কতই না কষ্টকর নাইনাই এর জীবন। 
মাঝে বেশ কিছু দিন নাইনাই এর দেখা পাইনি। ভেবেছিলাম হয়ত কোথাও ঘুরতে গেছে। সেজন্য অনলাইন থেকে বাসায় পণ্য আনার পরে প্রাপ্ত বক্সগুলোকে নাইনাই কে দেব বলে না ফেলে ব্যালকনিতে জমিয়ে রেখেছিলাম। প্রায় মাস খানিক পর থেকে আবারো নাইনাই এর দেখা পেলাম। ভাবলাম বাসার বক্সগুলো নাইনাই কে ডেকে দেওয়া দরকার। কিন্তু কিভাবে ওনাকে বোঝাবো যে বাসায় তোমার জন্য অনেক বক্স জমিয়ে রেখেছি। সেজন্য একটু হলেও মুশকিলে পড়ে গেলাম। একটা উপায় বের করলাম। আমরা যে কমিউনিটিতে থাকি নাইনাই ও একই কমিউনিটির বাসিন্দা। সকালে উনি যখন যায় তখন মাঝেমধ্যে বাসার ব্যালকনি থেকে দাঁড়িয়ে নাইনাই কে দেখা যায়। অন্তুও বেশ কয়েকদিন নাইনাই কে দেখেছে। তাই অন্তুকে বলা হয়েছে কখন নাইনাই যাবে সেটা দেখার জন্য। অন্তু প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে পাহারা দেয় নাইনাই কখন যাবে সেটা দেখতে। বেশ কিছুদিনের মাথায় অন্তু একদিন নাইনাই কে দেখতে পেল। ব্যালকনি থেকে অন্তু ডাকা শুরু করল। ওর ডাক শুনতে না পেয়ে নাইনাই সাড়া দেইনি। এরপর অন্তু আমাকে গিয়ে বলার পরপরই আমি এসে নাইনাই কে জোরে ডাক দিলাম। নাইনাই উপরে তাকালো। আমি চাইনিজে আমাদের বাসার নাম্বার বলে ওনাকে আসতে বললাম। নাইনাই আসল। ভিতরে ডেকে বসতে বললাম। অন্তুকে আগেই কোলে জড়িয়ে আদর করে নিল। বসতে বসতে অনেক কথা বলল। কিছুই বুঝলাম না।
এরপর বক্সগুলো দিলাম। প্রথমে উনি একেবারেই নিতে চাইছিল না। আমাকে বোঝাতে চাইছে নিচে এগুলো বিক্রির দোকান আছে। উনি আমাকে দোকান দেখিয়ে দেবে। সেখানে গিয়ে আমি যেন এগুলো বিক্রি করে আসি। আমি নাইনাইকে বললাম তুমি বিক্রি কইর। উনি রাজি হল। এরপর পকেট থেকে একটা ছোট্ট টাকার ব্যাগ বের করল। আমাকে টাকা দেবে। আমি অস্বীকার করাতে আর বেশি জোরাজুরি করেনি টাকা নেওয়ার জন্য। এরপর দেখলাম অন্য পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বের করল। বয়স আশির উপরে হলে কি হবে, স্মার্ট ফোন ব্যবহারে নাইনাই অনেক পারদর্শী। টাচ স্ক্রিন চেপে নাম্বার বের করে কল দিয়ে কার সাথে কথা বলল। কিছুক্ষন পরে নাইনাই এর এক নাতনি (অন্তুর থেকে বয়সে একটু বড়) আসল আমাদের বাসায়। বক্সগুলো দুজনে নিয়ে লিফেট তুলে আমাদের থেকে বিদায় নিল। নিচে তাকিয়ে দেখলাম। নাইনাই এর একটা কার্ট আছে। সেটা আনার জন্যই মূলত উনি নাতনিকে কল দিয়েছিল। পরে নাতনি আর উনি বক্সগুলো কার্টে লোড দিয়ে পায়ে হেঁটে ওদের বাসার দিকে চলে গেল। 
একদিন সন্ধ্যায় আমরা হাটতে বের হয়েছি। আমাদের সাথে ছিল অন্তুর বান্ধুবি এবং ওর মা। নাইনাই দেখলাম একটা প্রাইভেট কার থেকে নামছে। নামতে গিয়েই আমাদের সাথে নাইনাই এর দেখা। অন্তুকে কোলে নিতে চাইছে। আমি সে সুযোগে নাইনাই এর ব্যাপারে অন্তুর বান্ধুবির মায়ের কাছে বিস্তারিত জানতে চাইলাম। উনি বললেন ‘চীনা বয়স্ক ব্যক্তিরা সবসময় নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখতে চায়। নাইনাই ও ঠিক তেমন। যে প্রাইভেটকার থেকে নাইনাই নামল সেটা ওনার ছেলের গাড়ী’। কোথা থেকে যেন তারা ফিরছিলেন। তার ছেলে বেশ ভালো মানের চাকুরী করে। আমরা নাইনাই এর ব্যাপারে এসব শোনার পরে একটু অবাকই হলাম। বুঝলাম বক্স কুড়ালেও নাইনাই টোকাই না। কাজকে নাইনাই অনেক বেশী ভালোবাসে। সেজন্য অবসরকে যথোপযুক্ত ব্যবহার করে। সাথে এটাও বুঝলাম চীনারা যেকোন কাজকে যথেষ্ট মর্যাদার সাথেই দেখে। হতে পারে সেটা অনেক ছোট। আমাদের চোখে হতে পারে কাজগুলো নিকৃষ্ট মানের। কিন্তু চীনাদের কাছে কোন কাজই নিকৃষ্ট নয়। তাইতো বয়স্ক মানুষেরা ও একটি মুহূর্ত বসে নষ্ট করেনা। যেটা সাহায্য করে তাদের মনকে উৎফুল্ল ও প্রাণবন্ত রাখতে। সাথে নিরোগ জীবনযাপন করতে। কেউ কাউকে সামাজিক ভাবে এসব ছোটখাট কাজ করাকে হেয় না করে তাদেরকে যথেষ্ট মর্যাদার সাথে দেখে। আর সেজন্যই মানুষে মানুষে বিভেদ এখানে দেখা যায় না। 

লেখকঃ অজয় কান্তি মন্ডল
গবেষক
ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি
ফুজো, ফুজিয়ান, চীন।

সংবাদটি শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী সংবাদ
পরবর্তী সংবাদ