ডা.এম.এ.মান্নান,টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি
টাঙ্গাইলের নাগরপুরে বর্ষাকালে চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা আর চলাচল নৌকা ছাড়া যেন অনেকটাই অচল। এসব এলাকার মানুষের নিত্যপ্রয়োজনে যুগ যুগ ধরে উপজেলার ঐতিহ্যবাহী গয়হাটার উদয় তারা উচ্চ বিদ্যালয় এবং গয়হাটা কেন্দ্রীয় ঈদগাঁও মাঠে চলে আসছে নৌকার হাট।
ব্যবসায়ীরা বলেন, চাম্বল, কড়ই, মেহগনি, রেইনট্রি ও আম গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন প্রকার নৌকা মেলে এই হাটে। আকার ও মানভেদে প্রতিটি নৌকা তিন হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও আশপাশের মানিকগঞ্জের ঘিওর, শিবালয় থেকে ক্রেতারা এই হাটে আসেন নৌকা কিনতে। অন্যান্য হাটের তুলনায় নৌকার দাম কম হওয়ায় প্রতিবছরই জমে উঠে এ নৌকার হাট। তবে বর্তমানে করোনা সংক্রমণ বাড়ায় একদিকে যেমন আতঙ্কিত মানুষ অপর দিকে লকডাউন থাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ক্রেতা অনেক কম। কেবলই তাই নয় এবার নদীতে পানিও তেমন না বাড়ায় নৌকা কিনতে ক্রেতারা এখনো তেমন আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। তবে পানি আরও বাড়লে নৌকা বিক্রি ভাল হবে মনে করছেন ওই সকল নৌকা বিক্রেতারা।
এ উপজেলাটি যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীবেষ্টিত। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য খাল-বিল ও ডোবা-নালা ও শাখা নদীও। বর্ষার সময় এগুলো পানিতে থাকে টইটম্বুর। এসব উপজেলায় রয়েছে বিভিন্ন চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল। নদ-নদী থেকে পানি উপচে পড়লে রাস্তাঘাটে পানি উঠে পড়ে। তখন চলাচলের প্রধান বাহন নৌকা। এ ছাড়া কৃষিকাজ, গোখাদ্য, খেত থেকে সবজি ও ফসল সংগ্রহ করে বিক্রি, মাছ শিকার ও হাটবাজারে নিয়ে যাওয়া এবং খাল-বিল থেকে শাপলা তোলাসহ নানান প্রয়োজনে নৌকা অপরিহার্য। আবার অনেকে সখের বশেও করে থাকেন নৌকা ব্যবহার।
হাটে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন আকৃতি ও কাঠের তৈরি নৌকার পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। সারি সারি করে রাখা এসব নৌকার দৃশ্য দেখে যে কারোরই মনে ঢেউ জাগবে। ঈদগাহের বিশাল মাঠ জুড়ে বসেছে এই হাট। ভোর থেকেই জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন যানবাহন করে ব্যবসায়ীরা নৌকা নিয়ে হাটে এসেছেন। তবে ক্রেতা না থাকায় বেশির ভাগ বিক্রেতারাই খোশ গল্পে মেতে আছেন।
১৮টি নৌকা নিয়ে সকালে হাটে এসেছেন গয়হাটা গ্রামের মেঘু শীলের ছেলে শ্যামল ব্যাপারী। বিকাল পর্যন্ত মাত্র বিক্রি হয়েছে তাঁর দুইটি নৌকা। এখনো আরও ১৬টি নৌকা অবিক্রিত রয়েছে। তিনি নিজেও নৌকা বানান এবং পাইকারী কিনে ঘিওর বাজারে বিক্রি করেন। তিনি জানালেন, আকার ও কাঠের প্রকারভেদে একেক নৌকার দাম একেক রকম হয়ে থাকে। একটি ১০ হাতি নৌকা তৈরিতে দুই জনের সময় লাগে এক দিন। কাঠ ও মজুরি মিলিয়ে খরচ যা পড়ে তা বর্তমানে বিক্রির তুলনায় নৌকা বিক্রিতে ক্ষতির সম্ভবনাই বেশি। এ ভাবে বিক্রি হতে থাকলে চালান নিয়ে ঘরেও ফেরা হবে না। বিভিন্ন সাইজের নৌকার মধ্যে হাটে সাধারণত ১০ ও ১২ হাতি নৌকার চাহিদাই বেশি বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি।
উপজেলার গয়হাটার ঘুনি এলাকার কার্তিক সূত্রধরের ছেলে গোর চান সূত্রধর ৩টি নৌকা নিয়ে হাটে এসেছেন। বাপ-দাদার পেশায় তিনিও। তাই নিজে নৌকা বানিয়ে স্থানীয় হাটেই বিক্রি করেন। লকডাউনে বেচাকিনি নেই বলে ১০ হাজার টাকার নৌকা ছয় হাজার টাকা করে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তিনিও মাত্র দুইটি নৌকা বিক্রি করেছেন। তবে লকডাউন উঠিয়ে দিলে এবং পানি বাড়লে নৌকার চাহিদা বেড়ে যাবে তখন দামও ভাল পাওয়া যাবে বলেও জানান তিনি।
হাটের ইজারাদার রাজিব আহমেদ জানান, এ হাটে প্রতিটি বিক্রিত নৌকা থেকে এক'শ থেকে তিন'শ টাকা টোল আদায় করা হয়। বর্ষার সময় প্রতি হাটে দুই শত ৫০ থেকে তিন'শ নৌকা ওঠে। বেশির ভাগ সময় প্রায় নৌকাই হাটে বিক্রি হয়ে যায়। তবে বর্তমানে নৌকা বিক্রি কিছুটা কম হলেও হাটের শেষ সময়ে যতগুলো নৌকা থাকে তা বিভিন্ন এলাকার ব্যাপারীরা পাইকারী দরে কিনে অন্য হাটে নিয়ে তাঁরা বিক্রি করে থাকেন।