এখান থেকেই তিনি বড় হয়ে কলকাতায় যান, পড়াশোনা করেন এবং একসময় হয়ে ওঠেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি সাংবাদিকদের একজন।শিশির কুমার ঘোষ ও তাঁর ভাই মতিলাল ঘোষ ছিলেন হরি নারায়ণ ঘোষ ও অমৃতময়ী দেবীর সন্তান। মায়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকে দুই ভাই গ্রামের এক কোণে গড়ে তোলেন একটি বাজার—নাম দেন ‘অমৃতবাজার’। শুধু বাজারেই সীমাবদ্ধ থাকেননি তাঁরা, এই নামেই প্রকাশ করেন একটি সংবাদপত্র—‘অমৃতবাজার পত্রিকা’। এটি ছিল তাঁদের স্বপ্ন ও সাহসের প্রতীক, যা সময়ের পরিক্রমায় হয়ে ওঠে ভারতের জাতীয়তাবাদী সাংবাদিকতার এক বাতিঘর।
১৮৬৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি যশোরের অমৃতবাজার গ্রামে মাত্র ৩২ টাকা দিয়ে কেনা কাঠের ছাপার যন্ত্র দিয়ে প্রকাশিত হয় পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা, সাপ্তাহিক আকারে। শোষিত নীলচাষিদের পক্ষে কথা বলাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। পরে ১৮৭১ সালে প্লেগের প্রকোপে এটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয় এবং বাংলা ও ইংরেজি—দ্বিভাষিক রূপে প্রকাশ হতে থাকে। ১৮৭৮ সালে পত্রিকাটি সরকারবিরোধী হয়ে ওঠায় লর্ড লিটন ‘ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করেন, যা মূলত এই পত্রিকাটিকেই লক্ষ্য করে তৈরি হয়েছিল।
পত্রিকাটি ১৮৯১ সালে পূর্ণাঙ্গ দৈনিকে রূপ নেয় এবং ভারতীয় মালিকানাধীন প্রথম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চর্চা শুরু করে। একসময় ভাইসরয়ের গোপন চিঠি উদ্ধার করে তা প্রকাশ করে আলোড়ন তোলে, কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে তা ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শিশির ঘোষ ও মতিলাল ঘোষ শুধু সম্পাদক ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সৈনিকও। বাল গঙ্গাধর তিলকের পক্ষে তহবিল সংগ্রহ, বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা, লর্ড কার্জনকে খোঁচা দিয়ে লেখা সম্পাদকীয়—সব মিলিয়ে অমৃতবাজার পত্রিকা হয়ে ওঠে জাতির বিবেক।
এমনকি স্বাধীনতার পরে ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় এই পত্রিকা তিনদিন সম্পাদকীয় স্তম্ভ ফাঁকা রেখে দেশবাসীকে নিঃশব্দে আহ্বান জানিয়েছিল সম্প্রীতির। আর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট এক ঐতিহাসিক সম্পাদকীয়তে লিখেছিল—“এই হল ভোর, যদিও এটা মেঘাচ্ছন্ন। বর্তমানে সূর্যালোক একে ভাঙবে।”
১৯৯১ সালে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হলেও, তার গৌরবময় অতীত হারিয়ে যায়নি। বর্তমানে পত্রিকাটির পুরোনো সংখ্যা সংরক্ষণের জন্য নেওয়া হয়েছে ডিজিটাল সংরক্ষণের নানা উদ্যোগ। দিল্লির নেহেরু মেমোরিয়াল লাইব্রেরি ও জাতীয় বিজ্ঞান কেন্দ্রে সংরক্ষিত আছে তার ছাপার যন্ত্র ও আর্কাইভ।
এই গ্রাম, এই নদী, এই নাম—সবকিছু মিলিয়ে অমৃতবাজার শুধু ইতিহাস নয়, এটি আমাদের জাতির আত্মার অংশ। অমৃতময়ী দেবীর নামধারী এই গ্রামটি আজও সাক্ষ্য দেয়—কিভাবে এক মায়ের স্মৃতি বয়ে নিয়ে যায় একটি জাতির সংবাদচেতনার উত্থান পর্যন্ত। শিশির কুমার ঘোষ শুধু একটি পত্রিকার জন্ম দেননি, তিনি জন্ম দিয়েছিলেন একটি স্বপ্নের—স্বাধীনতা, ন্যায়ের এবং দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার স্বপ্ন।
উৎসঃ সাজেদুর রহমান বকুল ভাই এর আইডি থেকে সংগৃহীত