মোহাঃ ফরহাদ হোসেন,কয়রা প্রতিনিধি : সুন্দরবনে মাছের পাশ পারমিট বন্ধ হওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছে সুন্দরবন উপকূলের হাজার হাজার জেলে পরিবার। যাদের নুন আনতে পানতা ফুরায় সুন্দরবনের উপরে নির্ভরশীল এমন পরিবারগুলোর দিন কাটছে না খেয়ে । অধিকাংশ জেলে পরিবারগুলো জড়িয়েছে বিভিন্ন এনজিওর সুদের জালে।
পহেলা জুলাই থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বন বিভাগ। ২৪ জুন থেকে সুন্দরবনে প্রবেশের জন্য সব পাশ ও পারমিট দেওয়া বন্ধ রেখেছে বন বিভাগ। এর আগে গত বছর দুই মাস সুন্দরবনে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। নদীর কূলে বসবাসরত জেলেরা মাছ ধরেই দিনযাপন করে থাকেন। অধিকাংশ জেলেরা মাছ ধরা ছাড়া আর অন্য কোনো কাজের সাথে সম্পৃক্ত নয়, এছাড়া অনেকেই মাছ ধরা ছাড়া আর অন্য কোনো কাজ পারেন না।
সুন্দরবন উপকূলে কথা হয় কয়েকজন জেলের সাথে, কথা বলতেই তারা বলতে থাকেন তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা। বংশ পরম্পরা জেলে পেশার সাথে যুক্ত আলতাফ হোসেন বলেন, দীর্ঘ ১০/১৫ বছর ধরে জঙ্গলের সাথে সম্পর্ক, পাশ পারমিট খুবই প্রয়োজন। পাশ না পেলে না খেয়ে মরে যেতে হবে। আমি তো সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল, পাশ বন্ধ থাকায় এখন বাড়িতে বসা, ঋণের উপর চলছে আমার ১০ জনের সংসার ।
তিনি আক্ষেপের সাথে বলেন, সুন্দরবনে প্রবেশের পাশ দিলে সুন্দরবনের বরং উপকার হবে। কোন ক্ষতি হবে না। পাশ না দিলে কাঁকড়া, মাছ নির্দিষ্ট সময়ে মারা যাবে, তাতে ক্ষতি হবে। তিনি আরো বলেন আগে জানতাম জানুয়ারি – ফেব্রুয়ারি এই ২ মাস পাশ বন্ধ থাকে কিন্তু এখন দেখছি ইচ্ছা মত বন্ধ থাকে।
বনজীবী কৃষ্ণ মুন্ডা বলেন, এখন স্ত্রী সন্তান নিয়ে খুব খারাপ অবস্থা, এক দিকে করোনা ভাইরাস, ঘূর্ণিঝড় আম্পান, অন্য দিকে জীবিকা নির্বাহের একটি মাত্র পথ সেটাও বন্ধ। মানুষের বাড়ি হাজরী খাটতাম তাও বন্ধ। বনে প্রবেশের পাশ পারমিটটা খুবই প্রয়োজন আমাদের।
আম্পানে এলাকার প্রায় সকল মানুষের কম বেশি ক্ষতি হয়েছিল, কিন্ত এলাকার মানুষ ভেবে ছিল সুন্দরবনে যেয়ে মাছ- কাঁকড়া ধরে ক্ষতিটা পুষিয়ে উঠবে সেটাও হলো না। মহাজনেরা আর ঋণ না দেওয়ার কারণে বনজীবীরা বাধ্য হয়ে বিবিন্ন এনজির মাধ্যমে ঋণ নিয়েছে সংসার চালানোর জন্য। অনেকেই ভেবেছিল মাছ ও কাঁকড়া ধরে কিস্তির মাধ্যমে ঋণের টাকা পরিশোধ করবে, তারাও এখন কিস্তি নেওয়া শুরু করেছে।
অসহায় জেলে পরিবার গুলো আরো বলেন, পাশ পারমিট না দিলে চুরি ডাকাতি বৃদ্ধি পাবে, পরিবারে অশান্তি দেখা দেবে। দীর্ঘ দিন পাশ বন্ধ থাকলে বনজীবীরা ভিন্ন পেশা বেছে নেবে, ফলে বনজীবীরা তাদের পেশা হারাবে।
এ সময়ে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি থেকে বাঁচতে তাদের মাস্ক ব্যবহারের কথা বললে তারা বলেন, করোনা ভাইরাসের কথা আমাদের মনেই নেই, কারণ আয় উপার্জন নেই। আয় না থাকলে তো এমনিই মরতে হবে, তা আর করোনার ভয়ে মাক্স পরে কি হবে।
পাশ পারমিট বন্ধ বিষয়ে কয়রা সদর ইউপি চেয়ারম্যান এইচ,এম, হুমায়ুন কবির বলেন, পাশ বন্ধ থাকায় সুন্দরবন ‚উপকূলের জেলেরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বনবিভাগ এলাকার নদীতেও মাছ ধরা বন্ধ করেছে। মাছ ধরা বন্ধ থাকায় ঋণের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে জেলে পরিবার গুলো।
পশ্চিম সুন্দরবনের সহকারী বন সংরক্ষণ কর্মকর্তা বলেন, সুন্দরবনে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানস এর (আইআরএমপি) সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সালে সুন্দরবন বন বিভাগ একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। যার অংশ হিসেবে প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের (পূর্ব ও পশ্চিম) সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ থাকবে। এই দুই মাস সুন্দরবনের নদী খালে থাকা বেশির ভাগ মাছের প্রজনন মৌসুম। যার ফলে এ সময় মাছ ধরা বন্ধ থাকলে সুন্দরবনের নদী খালে যেমন মাছ বৃদ্ধি পাবে, তেমনি অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদসহ সব জীবের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিবছর একই সময়ে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ থাকবে। এ সময়ে চোরা শিকারিরা যাতে মেতে না উঠতে পারে সে জন্য বনে টহল জোরদার করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা ২৪ জুন থেকে সুন্দরবনে প্রবেশের জন্য জেলেদের পাশ পারমিট দেওয়া বন্ধ রেখেছি। ২৩ তারিখ পর্যন্ত যাদের পাশ-পারমিট দেওয়া হয়েছে তাদেরকে ৩০ জুনের মধ্যে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ৩০ জুনের পরে কাউকে বনের ভেতরে পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।